
শত কোটি টাকা লুণ্ঠনকারী ফার্মাসিটিক্যালস কোম্পানি এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ পুুঁজিবাজারে আসতে উঠেপরে লেগেছে। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির কথা থাকলেও মিথ্যা তথ্য ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের আইপিও আবেদন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতিক উক্ত কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আই পি ও এর অনুমোদন পেতে বিএসইসির কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রফাদফা করেছে। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৯৫ কোটি টাকা উত্তোলনের জন্য কোম্পানিটি আইপিও অনুমোদন চায়। এ অশুভ কোম্পানিকে পুুঁজিবাজারে আনতে মার্চেন্ট ব্যাংক, বিএসইসি,অডিট ফার্ম একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে বলেও জানা গেছে।
উল্লেখ্য, কারওয়ান বাজার মৌজাস্থিত ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ সম্পত্তিটির মালিক রাজধানীর ১১/৮/সি, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট নিবাসী একেএম খোরশেদ আলম। সম্পত্তির ওপর রয়েছে ৮তলা ভবন। এটি বন্ধক রেখে অগ্রণী ব্যাংক আমিনকোর্ট শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি। যে দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তিটি অগ্রণী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখেছেন সেটির নম্বর-৩৩৫২। দলিলটি সম্পাদিত হয়েছে ২০১৩ সালে তেজগাঁও সাব রেজিস্ট্রি অফিসে। তৎকালিন সাব-রেজিস্ট্রার এসএম সোহেল রানা মিলনের স্বাক্ষরে দলিলটির নিবন্ধন হয়। দলিলটি ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ হওয়ায় সম্পত্তির মূল্যমান ছিল অনির্ধারিত।
এই দলিলের সম্পত্তিই ‘নিজের’ দাবি করে ইনিশিয়াল পাবলিক অফার (আইপিও) ছাড়ার পরিকল্পনা করছে ‘এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লি:’ নামের ওষুধ কোম্পানি। তবে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত হওয়ার আগেই প্রতিষ্ঠানটির আইপিও স্থগিত করা হয়েছে। এ কোম্পানির বিরুদ্ধে উঠেছে জালজালিয়াতির নানা অভিযোগ। সম্পত্তির অবিশ্বাস্য অতিমূল্যায়নের অভিযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে আইপিও ছেড়ে ৯৫ কোটি টাকা তুলে নেয়ার আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত।
প্রসপেক্টাসের তথ্যমতে, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড কোম্পানির শেয়ারের কাট-অফ প্রাইস নির্ধারিত হয়েছে ৫০ টাকা। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এই ৫০ টাকার ৩০% ডিসকাউন্ট অর্থাৎ ৩৫ টাকা অথবা ২০ টাকা, যেটি কম সে মূল্যে শেয়ার পাবেন। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের প্রতিটি শেয়ার ২০ টাকা করে কিনতে পারবেন।
অভিযোগ উঠেছে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানিটিকে ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট বিডিংয়ের অনুমতি দেয়। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ৯৫ কোটি টাকা তুলবে। তবে প্রায় শত কোটি টাকা সংগ্রহ কিংবা লুণ্ঠন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় ভয়াবহ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে। এতে অন্যের সম্পত্তি নিজের বলে দাবি করা হয়। সে অনুযায়ী বিশ্বাসযোগ্যভাবে সৃজন করা হয় সম্পত্তির দলিলপত্রও। গুরুতর এই অভিযোগ সত্ত্বেও এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লি:-এর আইপিও অনুমোদনপ্রাপ্তিসহ সব ধরনের সহায়তা করে মার্চেন্ট ব্যাংক ,বিএসইসি, অডিট ফার্ম একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে আইপিও ছাড়ার অনুমোদন গ্রহণের ক্ষেত্রে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড সম্পত্তির মূল্য দেখিয়েছে ১৪ গুণ অতিরিক্ত। পুঁজিবাজারের নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যেই প্রিমিয়াম বেশি আদায় ও বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করতে পারিবারিক ওষুধ কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে অতিরঞ্জিত ও ভুয়া তথ্য। অসদুদ্দেশ্য বাস্তবায়নে চাহিদানুগ আর্থিক প্রতিবেদনটি তৈরি করে দেয় ‘আশরাফউদ্দিন অ্যান্ড কোং’ নামের একটি অডিট প্রতিষ্ঠান। আর শেয়ার ইস্যু করেছে ‘শাহজালাল ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট’ নামক আরেক বিতর্কিত পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।
এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লি:-এর আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ৯৩ লাখ টাকা পেইডআপ ক্যাপিটালের প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালে হঠাৎ করেই ৮৭ কোটি টাকা মূলধনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অর্থাৎ মাত্র ২ বছরে ওষুধ কোম্পানিটির মূলধন বেড়ে যায় ৮৭ গুণ। কীভাবে ঘটল মূলধনের এই স্ফীতি? প্রসপেক্টাসে অবিশ্বাস্য এই পুঁজি বৃদ্ধির কোনো ব্যাখ্যা নেই।
প্রসপেক্টাসের ১২ নম্বর পৃষ্ঠায় পরিশোধিত মূলধনের কিছু তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ১৯৭০ সালে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের পেইডআপ ক্যাপিটাল ছিল ১ হাজার টাকা। ১৯৯৮ এটি উন্নীত হয় ৭০ হাজার ৩৫০ টাকায়। অর্থাৎ ২৮ বছর প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়েছে ১০০০ টাকা মূলধন নিয়ে। ২০০৫ সালে পেইডআপ ক্যাপিটাল হয় ৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। ইনিশিয়াল প্রাইমারি পাবলিক অফারিংয়ের অনুমোদন পেতে হঠাৎ করেই কোম্পানিটি মূলধন দেখায় ৮০ কোটি ৪০ লাখ ৯ হাজার ৬৫০ টাকার নগদ ডিপোজিট। সাড়ে ৬ কোটি টাকার বোনাস শেয়ার দিয়ে মূলধন হয়ে যায় ৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এ ক্ষেত্রে মালিকানাধীন সম্পত্তির মূল্য দেখানো হয় ওই সময়ে সংশ্লিষ্ট মৌজা মূল্যের চেয়ে অন্তত ১৪ গুণ বেশি। ২০১৪ সালে গাজীপুর কালিয়াকৈরে মৌজাদর ছিল কাঠাপ্রতি ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকা করে কাঠা মূল্য ধরে দলিল করে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লি:। এভাবে ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত কালিয়াকৈর মৌজায় মোট সম্পত্তির মূল্য দেখানো হয় ১১ কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। শুধু কি তাই? ২০১৬ সালেই গাজীপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের মূল্যতালিকায় কালিয়াকৈর ঠাকুরপাড়া মৌজায় এক ডেসিমেল জমির সর্বোচ্চ দাম ছিল ৪৫ হাজার ৬৭৬ টাকা। ওই মৌজায় ৫৪২ ডেসিমেল জমি দেখায় এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ। এর মধ্যে ২০১০ সালে ২৫০ ডেসিমেল জমির মূল্য দেখায় ৫ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে খরিদকৃত ১৩২ ডেসিমেল জমির দলিল মূল্য দেখানো হয় ২ কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। একই বছর মার্চে কেনা হয় ৯৪ ডেসিমেল জমি। মে মাসে কেনা হয় ৬৬ ডেসিমেল জমি। এ দু’টির মূল্য যথাক্রমে ২ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও ১ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। ওই সময় গাজীপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে দায়িত্ব পালনকারী কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন দলিলে একেক কাঠা জমির মূল্য ১৩ থেকে ১৪ গুণ বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৬ সালে টঙ্গীর মাছিমপুর মৌজায় এক ডেসিমেল জমির সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ১৬ লাখ ২৯ হাজার ৩১৮ টাকা। কিন্তু এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ এখানকার জমিগুলোত ক্রয় মূল্যের ব্যবধান রয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকা। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পএলাকায় প্রতি ডেসিমেল জমির মৌজা রেট ছিল ৩৪ লাখ ৪ হাজার ৮০০ টাকা। এ হিসেবে ৩৩ ডেসিমেল জায়গার দাম ১১ কোটি সাড়ে ২৩ লাখ টাকা। কিন্তু এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ দেখিয়েছে ৩২ কোটি টাকা। তেজগাঁওয়ের এই সম্পত্তির প্রকৃত মালিকানা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বিরাট প্রশ্ন।
প্রসপেক্টাসে জমির যে দলিল নম্বর (৩৩৫২) এবং সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল সম্পাদিত হয়েছে মর্মে উল্লেখ রয়েছে সেটির প্রকৃত মালিক জনৈক একেএম খোরশেদ আলম। এটি ছিল হাবিব ব্যাংকের সম্পত্তি। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট অর্ডার মূলে সম্পত্তিটি জাতীয়করণ করা হয়। ওই ব্যাংক সম্পত্তিটি নিলামে তুললে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার শোলা গ্রামের মরহুম মৌলভী গগন আলী খানের পুত্র একেএম খোরশেদ আলম সম্পত্তিটি কেনেন। এই সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। দলিল লেখক দলিলটি পেশ করলে তৎকালিন সাব- রেজিস্ট্রার এসএম সোহেল রানা ১৬/০৭/২০১৩ তারিখ স্বাক্ষর করেন।
কোম্পানির প্রসপেক্টাসে তেজগাঁওয়ের সম্পত্তিটির ‘দলিল মূল্য’ উল্লেখ করেছেন ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রসপেক্টাসের বিভিন্ন স্থানে অন্তত : ৭টি সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে এসবের মূল্যমান উল্লেখ করে। এর মধ্যে রয়েছে গাজীপুর কালিয়াকৈর, ঠাকুরপাড়ায় ২৫০ ডেসিমেল জমি (দলিল নং-৬৪৯১, মূল্য-৫০০০০০০০ টাকা), একই এলাকায় ১৩২ ডেসিমেল জমি (দলিল নং-৬৪৮৮, মূল্য-২৯০,৪০০০০ টাকা), ঠাকুরপাড়ায় ৯৪ ডেসিমেল জমি (দলিল নং-১৮৮৯, মূল্য-২০,৬৮০০০০ টাকা), একই মৌজায় ৬৬ ডেসিমেল জমি (দলিল নং-৬৫০০, মূল্য-১৪,৫২০০০০ টাকা), টঙ্গির মাছিমপুর মৌজায় ৯২.৮ ডেসিমেল জমি (দলিল নং-১১৮০৫, মূল্য-৪১৭৯০০০০০ টাকা), টঙ্গির একই মৌজার ০.৬ ডেসিমেল জমি (দলিল নং-১৯০৮০, মূল্য-২,৭০০০০০ টাকা) এবং ঢাকার তেজগাঁও মৌজায় ৩৩ ডেসিমেল জমি (দলিল নং-৩৩৫২, মূল্য-৩২৫০০০০০০ টাকা)। কোম্পানির উল্লেখিত সব সম্পত্তির মোট মূল্য দেখানো হয়েছে ৮৫ কোটি ৯৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর বাইরে রয়েছে রেজিস্ট্রেশন খরচ-৯৪,৫৭৭,৪৪৯ টাকা। জমির উন্নয়ন খরচ-৩৬৮,৬০৩,০২৪ টাকা। এভাবে কোম্পানির মোট সম্পত্তির মূল্য দেখানো হয়েছে ১৩২ কোটি ৩০ লাখ ২০ হাজার ৪৭৩ টাকা। ৩০৪ পৃষ্ঠার এই প্রসপেক্টাসের ৯৯ নম্বর পৃষ্ঠায় এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের সম্পত্তির এই মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই সম্পত্তির এই হিসেবকে গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটি একচেঞ্জ কমিশন। প্রতিষ্ঠানটিকে ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (আইপিও) ছাড়ার অনুমোদনও দিয়েও পরবর্তীতে তা স্থগিত করা হয়।
একেএম খোরশেদ আলম খান জানান, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড’র প্রসপেক্টাসে নিজ দলিলের উল্লেখ দেখে তিনি আকাশ থেকে পড়েন। খোরশেদ আলম বলেন, এটি কেমন করে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের সম্পত্তি হলো? দলিলে উল্লেখিত তফসিলভুক্ত সম্পত্তির মালিক আমি। এটি এখন অগ্রণী ব্যাংকে বন্ধক রয়েছে। ভুক্তভোগী খোরশেদ আলম খান কোনো জালিয়াতচক্রের খপ্পরে পড়েছেন-নিশ্চিত হন। আইনগত পদক্ষেপ নিতে তিনি তৎক্ষণাৎ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ছুটে যান। কিন্তু রহস্যজনক কারণে থানা-পুলিশ তার সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত গ্রহণ করেনি।
দাবিকৃত সম্পত্তির ভুয়া দলিল, সম্পত্তির অতিমূল্যায়ণ এবং অস্বাভাবিক পেইডআপ ক্যাপিটাল বৃদ্ধির বিষয়ে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: মনির আহমেদ ভোরের পাতাকে বলেন, একবার স্থগিত হয়েছিল আমাদের কোম্পানির আইপিও। পরবর্তীতে তদন্ত করেও আমাদের বিরুদ্ধে কিছুই পাওয়া যায়নি। তাই আমরা পুঁজিবাজারে আসতে প্রস্তুত আছি।