
মাধবী,
আজ শহীদ ডাঃ শামসুল আলম খান মিলনের মৃত্যু বার্ষিকী, আজ ‘৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম এক মোড় ঘোরানো দিন, ১৯৯০ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ডাঃ মিলনকে হত্যা করেছিল। ঐদিনের ঘটনা এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বল জ্বল করছে। ১৯৯০ সালের ঐ উত্তাল দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম! তুমি তো জানো মাধবী, আমি ক্লাস এইটে পড়ার সময় থেকে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হই। সেই সুবাদে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র হলেও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সার্বক্ষণিক এক দায়িত্ববোধের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ ছিলাম। তো যেটা বলছিলাম, ২৭ নভেম্বর ‘৯০ এর কয়েকদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ভীষণ উত্তপ্ত ছিলো। ঐ বৎসর ১০ অক্টোবর আন্দোলনরত সকল ছাত্র সংগঠন সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে, ঐদিন পুলিশের গুলিতে মারা যায় সিরাজগঞ্জের ছাত্রদল নেতা জেহাদ। তারপর থেকেই ক্যাম্পাস উত্তপ্ত ছিলো। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তৎকালীন সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখলে নেওয়ার জন্য দুঃসাহস দেখায়, ক্যাম্পাসে তাঁদের অনুসারী সন্ত্রাসীরা কার্জন হল এলাকায় অবস্থান নেয়। কয়েকদিন ধরেই আমরা কলা ভবন এলাকার হলগুলোতে অবস্থান নেই। এভাবে উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথরিয়া পর্যন্ত!
মাধবী,
১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বরের আগেই সারা ঢাকা শহরে জরুরী অবস্থা ঘোষনা করা হয়। গোটা শহর থমথম করছিলো। ২৬ নভেম্বর রাতে আমরা জীবনের ভয় না করে দিব্যি কলা ভবন, মধুর ক্যান্টিন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া, হাকিম চত্বর এলাকাসহ টিএসসির আশেপাশে বীরদর্পে স্বৈরাচারের গুন্ডাদের মোকাবেলার জন্য প্রায় সারারাত পাহারা দিয়ে ২৭ নভেম্বর সকাল ৮টার সময় মধুর ক্যান্টিনে চা-নাস্তা খেয়ে, ৯ঃ৩০ মিনিটের সময় হাকিম চত্বরে যাই! হাকিম চত্বরের যেয়ে দেখি সেখানকার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে মাদারীপুরের মাহাবুব ভাই, টাঙ্গাইলের আবুহেনা ভাইসহ আরও কয়েকজন স্বস্বস্ত্র অবস্থায় টিএসসি ভবন-সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখান দিয়ে বাংলা একাডেমির দিকে যেতে যে রাস্তা সেদিকে অস্ত্র এ্যামবুশ করে বসে আছে। গোটা টিএসসি খাঁ খাঁ বিরাণভূমি! আমরা একটু দূরে বসে কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিলাম । হঠাৎ দেখি ডাসের সামনে দিয়ে একটা রিক্সা আসছে, এরপর গুলির শব্দ শুনলাম, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিক থেকে ভেসে আসা গুলির শব্দ, এরপর দেখলাম ঐ রিক্সা থেকে একজন লোক পড়ে গেলো। বুঝতে পারছিলাম না, কি হলো। হঠাৎ দেখি মাহবুব ভাই এবং সম্ভবত মোহাম্মদ মহসিন ভাই দৌড়ে রিক্সা থেকে পড়ে যাওয়া লোকটার কাছে ছুটে গেলো, তাকে কোলে নিয়েই চিৎকার দিয়ে বললেন, ডাঃ মিলন ভাই গুলিবিদ্ধ, আমাকে মাহবুব ভাই তাড়াতাড়ি মধুর ক্যান্টিনে খবর দিতে বললেন। আমি দৌড়ে মধুর ক্যান্টিনে যেয়ে দেখি শফি আহম্মেদ ভাই, রোকন ভাইসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রনেতা বসে আছেন। আমি যেয়ে বলার সাথে সাথে মধুর ক্যান্টিনে উপস্থিত সকল দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে বিদ্যুৎ গতিতে আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়লো, সব ছাত্র সংগঠন সাথে সাথে মিছিল বের করলো। শফি ভাই আমাকে বললেন, ‘তুই পিজি হাসপাতালে যেয়ে বলবি বিএমএ’র যুগ্ম মহাসচিব ডাঃ শামসুল আলম খানকে স্বৈরাচারের পেটোয়া বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে!’ জরুরী অবস্থা থাকার কারনে রাস্তায় সবকিছু বন্ধ। আমি মধুর ক্যান্টিন থেকে এক দৌড়ে মুজিব হলের পিছনের দেওয়ালের ভাঙা অংশ দিয়ে পিজি হাসপাতালের সি ব্লকে, যা যাদুঘরের উল্টো দিকে, গেলাম। সেখানেও শুনশান নিরবতা। একজন দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, লাইব্রেরিতে গেলে ডাক্তারদের অনেককে পেতে পারি। আমি দৌড়ে কয়েকতলা বেয়ে লাইব্রেরিতে পৌঁছলাম, ঢুকেই বললাম, ‘এ্যাটেনশন প্লিজ’, এই কথা শুনে পড়ারত ডাক্তাররা একটু বিরক্ত হলেন বলে মনে হলো। আমি আবার বললাম, ‘এ্যাটেনশন প্লিজ, আপনাদের বিএমএ’র যুগ্ম মহাসচিব ডাঃ শামসুল আলম খান মিলনকে কিছুক্ষণ আগে স্বৈরাচারের গুন্ডা বাহিনী গুলি করে টিএসসির রাস্তায় হত্যা করেছে!’ বিশ্বাস করো মাধবী, এই কথা বলার সাথে সাথে ডাক্তাররা দুই হাত দিয়ে বই বন্ধ করে দৌড়ে ছাদে চলে গেলেন, মিছিল করলেন ছাদ থেকে, সেই মিছিলের স্লোগান ছড়িয়ে পড়লো ঢাকা শহরের প্রায় সব বাড়ীর ছাদে ছাদে, বিশেষ করে শাহবাগ, হাতিরপুল, এ্যালিফ্যান্ট রোডসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের জনবহুল এলাকায় । সেদিন সেই মিছিলের উত্তাপ এতটাই ছড়িয়েছিল যে, সরকার একদিকে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছিল, অন্যদিকে সকালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল খালি করার নির্দেশ দিয়েছিল। আবাসিক হলের ছাত্র-ছাত্রীরা সকালে সকল হল গেটে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করলে সরকার জরুরী অবস্থা শিথিল করে ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ী যাওয়ার পথ সুগম করেছিল। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ডাঃ মিলনের নিথর মৃতদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁর সতীর্থদের কাছে রেখে গেলেও, প্রতিবাদের মশাল হাতে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছিল। এর ৯ দিনের মাথায়, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯০ এ সেই স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছিল! ডাঃ মিলন জীবন দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে যে গনতন্ত্র উপহার দিয়ে গিয়েছিল সেই গণতন্ত্র বিগত নৈরাজ্যবাদী শাসনামলে ধ্বংস করা হয়েছে। এদেশের মানুষ ডাঃ মিলনের কাছে চির ঋনী। মিলন ভাইকে মাঝেমাঝেই মনে পড়ে, আজ একটু বেশিই মনে পড়ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে মিলন ভাই শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন, আমরা জেগে আছি তাঁর রক্তের ঋণ পরিশোধের জন্য, গনতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্ন নিয়ে!
লেখক: অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ এবং রাজনৈতিক কর্মী