২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কলেজ আমলের বাস নিয়ে চালু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তর। প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পর ২০২০ সালে গিয়ে চালু হয় দুর্ঘটনায় প্রাপ্ত টাকার হিসেবের ফাইল। এর মধ্যে ১৫ বছরে বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে ক্ষতিপূরণ পেলেও হদিস নেই সেই টাকার। এদিকে সেই হিসেব নিয়ে একে অপরের দিকে দায় ঠেলাঠেলি করছেন সাবেক ও বর্তমান পরিবহন প্রশাসকেরা।
২০১৮ সালে মাওয়াতে যাওয়ার পথে শ্রীনগর এলাকায় রাস্তায় কর্মরত এক ভেকু গাড়ি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৪-০০৯০ নং) গাড়ির মাঝ বরাবর লাগিয়ে দেয়। এতে ক্ষতিপূরণ বাবদ রাস্তা কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তরকে ২৫ হাজার টাকা দেয়। তখন গাড়িটির চালক ছিলেন আতিকুর রহমান। পরবর্তীতে কয়েক মাস পর ঐ একই গাড়ি ইসহাক মিয়ার চালনায় ধলেশ্বরী ব্রীজ এলাকায় আবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। স্থানীয় এক রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১ লাখ টাকা পায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহন দপ্তর। কিন্তু দুটি দুর্ঘটনায় প্রাপ্ত মোট ১ লাখ ২৫ টাকার কোনো হিসাব নথিভুক্ত নেই। ওই টাকা থেকে গাড়ি মেরামতে কত টাকা খরচ হলো, তারও হিসাব নেই পরিবহন দপ্তরে।
গাড়িচালক আতিকুর রহমান বলেন, মাওয়া যাবার সময় ২০১৮ সালে ভেকু গাড়িতে আঘাত করায় ২৫ হাজার টাকা পাওয়া যায় সত্য। আমি থাকা অবস্থায় গাড়ির কোন খরচ হতে দেখিনি। পরে খরচ করেছে কিনা জানি না।
গাড়িচালক ইসহাক মিয়া বলেন, ধলেশ্বরী ব্রিজের ওপর স্থানীয় এক রাজনৈতিক ব্যক্তির মাইক্রো বাসকে সাইড না দেয়া নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে ঝামেলা বাঁধে। এতে রড দিয়ে গাড়ির দরজায় আঘাত করে স্থানীয়রা। মেয়ে শিক্ষার্থীসহ সবার সঙ্গে অশোভন আচরণ করে। তাই আমরা মামলা করলে মিমাংসা বাবদ ১ লাখ টাকা দেয়। মিমাংসার সময় প্রক্টরিয়াল বডি ও পরিবহন দপ্তরের লোকজন ছিল। মূলত ছাত্রদের গায়ে হাত দেয়ায় মামলা তুলতে টাকা দেয়। গাড়ির তেমন ক্ষতি হয়নি। মেরামতে কিছু টাকা খরচ হতে পারে। বাকি টাকার বিষয়ে জানা নেই।
এদিকে ওই দুই ঘটনা থেকে প্রাপ্ত ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার হিসাব জানতে গিয়ে আরো নানা তথ্য সামনে এসেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলেজ সময়ের বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ১৫ বছর পর্যন্ত গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাপ্ত টাকার হিসাবের ফাইলই চালু হয়নি। ২০২০ সালে ফাইল চালু হয়। মাঝের এই ১৫ বছরের বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকাও পেয়েছে বলে নানা গাড়িচালক সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু সেই টাকা কোন খাতে খরচ করা হয়েছে তার কোন নথিপত্র নেই পরিবহন দপ্তরে।
ফাইল চালু হওয়ার আগে পরিবহণ দপ্তরে প্রশাসক হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, তার আগে অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দিনসহ আরো অনেকে। তবে এবিষয়ে বর্তমান ও সাবেক পরিবহন প্রশাসকদের কাছে জানতে গেলে একে অপরের ওপর দায় ঠেলাঠেলি করছেন। তারা বলছেন, ওই টাকা সরাসরি গাড়ি মেরামত করা হতো। কিন্তু মেরামতের কোন বিল ভাউচার দপ্তরে নেই।
দপ্তরের গোপন সূত্রে আরো জানা যায়, ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রাপ্ত টাকা থেকে কিছু টাকা বাস মেরামতে খরচ করা হতো। বাকি টাকা আত্মসাতের জন্য কোনো হিসাবের নথি করা হয়নি।
এবিষয়ে বর্তমান পরিবহন প্রশাসক অধ্যাপক ড. সিদ্ধার্থ ভৌমিক বলেন, আমি পরিবহন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করি ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে যে দুর্ঘটনায় টাকা পাওয়া গেছে তা নথিভুক্ত আছে। কত টাকা খরচ বা জমা, সব আছে। আমার যোগদানের আগে কোন দুর্ঘটনার টাকা আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। এর আগে কি ঘটনা হয়েছে তা বলতে পারব না।
এদিকে ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পরিবহণ প্রশাসক ছিলেন অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ। তিনি বলেন, ভেকু গাড়ির সঙ্গে দুর্ঘটনায় কোন টাকা পাইনি। গাড়িচালকরা মিথ্যা বলছে। ধলেশ্বরী ব্রিজের টাকা থেকে কিছু গাড়ি মেরামত করা হয়। পরে বাকি টাকা পরিবহনে খরচ করা হয়। অনেক আগে থেকেই নথি ছিল না। নথি বাদে এভাবেই চলে আসছিল। ২০২০ সালে আমি প্রথম হিসাব নথি চালু করি। আমার আগের ঘটনারও নথি ছিল না। তাই আগের ঘটনা জানি না।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িচালকরা। এরপর পরিবহন দপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. শাহাদাৎ হোসেন তুষার ও দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবিরকে রেজিস্ট্রার দপ্তরে বদলি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে গাড়ি মেরামতে খরচ বেশি দেখানো, অফিস না করেও হাজিরা খাতায় উপস্থিতি দেখানো, যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ করা হয়।