বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিরোনাম: কোথায় নাথান বমের স্ত্রী ?    বাংলাদেশ জাতীয় দলের স্পিন বোলিং কোচ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মুশতাক আহমেদ    মিয়ানমারের বিজিপি ও সেনাবাহিনীর আরও ১৮ জন সদস্য পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন    বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালককে অপসারণ    ইরানের ড্রোন ভূপাতিত করায় চটেছে জর্ডানের জনগণ    রাঙামাটিতে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ৮ কেএনএফের সন্ত্রাসী আটক     সাগর নিয়ন্ত্রণে ইরানের আলোচিত হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
কবিতার কলতানে তিনি ফিরেছিলেন স্বদেশে
বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের অমর কাব্য ও কবিতার নাম
ড. কাজী এরতেজা হাসান
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৩, ১:০৮ এএম আপডেট: ১০.০১.২০২৩ ২:০৮ এএম | অনলাইন সংস্করণ

'বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা' গ্রন্থটি শুরু হয়েছে জসীমউদ্‌দীনের কবিতা দিয়ে এবং শেষ হয়েছে মুজিব ইরমের কবিতার মধ্য দিয়ে। এ গ্রন্থের ফ্ল্যাপ থেকে কিছু অংশ উলেস্নখ করছি- যেখান থেকে ধারণা পাওয়া যাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখার প্রবণতা ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে : 'বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে, যা তার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার বিশেষ পরিচয়বহ। ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডে কবিরা গভীরভাবে মর্মাহত হন। এর অভিঘাতেও রচিত হয়েছে অসংখ্য হৃদয়স্পর্শী কবিতা। সেসব কবিতা বেদনামথিত, প্রতিবাদ-প্রতিরোধে উচ্চকিত। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার ও পাকিস্তানের কারাগারে নয় মাসের বন্দিদশা, মুক্তি, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, স্বাধীন দেশ গড়ার প্রত্যয় ও কর্মপ্রয়াস, পনেরোই আগস্টের পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির উত্থান ও অপতৎপরতা এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাধারাও কবিসমাজকে বিপুলভাবে আলোড়িত করেছিল। তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে উপজীব্য করে অমিয় পঙ্‌ক্তিমালা রচনায়।

আবেগ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সেসব কবিতায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ছিল সপ্রতিভ ও সতেজ। বঙ্গবন্ধুর জীবন, সংগ্রাম, আদর্শের বহুমাত্রিক রূপায়ণের পাশাপাশি সেখানে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের লড়াই, সংগ্রামের চিত্র, আদর্শিক দ্বন্দ্ব ও প্রতিক্রিয়া। এভাবে কবিতার রূপ-রস-গন্ধে মানসপটে আঁকা হয়ে যায় 'রাজনীতির কবি' বঙ্গবন্ধুর উজ্জ্বল মুখচ্ছবি। বারবার ভেসে ওঠে স্বদেশের মুখ, প্রতিভাত হয় জনমুক্তি ও ইতিহাসের বর্ণিল ধারা। বঙ্গবন্ধুই যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি-কবিতার পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে তা-ই খচিত হয়ে আছে'।

গ্রন্থভুক্ত ১৩১টি কবিতায় প্রত্যেকে নিজের মতো করে বঙ্গবন্ধুকে তুলে আনতে চেয়েছে নানা অবয়বে। একই বিষয় অনেকের কবিতায় উপস্থিত থাকলেও কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। এতে করে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যক্রমও দৃশ্যমান হয়েছে কবিতার পঙ্‌ক্তিতে। গ্রন্থের প্রথম কবিতা জসীমউদ্‌দীনের লেখা। তার 'বঙ্গবন্ধু' কবিতায় পাওয়া যায় সামরিক সরকার, সাতই মার্চের ভাষণ, কারাবরণ, ভয়, ডরহীন বঙ্গবন্ধুর কথা। আবার বঙ্গবন্ধু সর্বস্তর এবং সর্বধর্মের মানুষের এক করেছেন। তার আহ্বানে মানুষ জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে এ প্রসঙ্গও মূর্ত হয়েছে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর 'গরাদভাঙার সংগ্রামীরা জাগো' কবিতায়। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে কয়েকটি কবিতা আছে। লিখেছেন সিকান্‌দার আবু জাফর, তিতাশ চৌধুরী, নূহ-উল-আলম লেনিন, কাজী রোজী। হাবীবুলস্নাহ সিরাজী লিখেছেন ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে দেখার উপলব্ধিকে পুঁজি করে- 'আমি অপেক্ষা করছি' কবিতা। তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য প্রতীক্ষ্যমাণ ছিলেন।

আমি তাকে দেখার জন্য মহাকাশের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম আমি তাকে দেখার জন্য সৌরমন্ডলে দাঁড়িয়েছিলাম আমি তাকে দেখার জন্য পৃথিবীতে দাঁড়িয়েছিলাম আমি তাকে দেখার জন্য বাংলাদেশে দাঁড়িয়েছিলাম আমি তাকে দেখার জন্য ঢাকা শহরে দাঁড়িয়েছিলাম আমি তাকে দেখার জন্য ধানমন্ডি দাঁড়িয়েছিলাম আমি তাকে দেখার জন্য ৩২ নম্বরে দাঁড়িয়ে আছি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা রয়েছে এ গ্রন্থে। যারা লিখেছেন- শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ রফিক, আবু কায়সার, সানাউল হক খান, অসীম সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, মাহমুদ আল জামান, রুবী রহমান, দাউদ হায়দার, ইকবাল হাসান, অঞ্জন সাহা, সাইফুলস্নাহ মাহমুদ দুলাল, ঝর্না রহমান, বদরুল হায়দার, আলফ্রেড খোকন, মুজিব ইরম। কী কারণে বা কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? এরই উত্তর খুঁজেছেন ময়ূখ চৌধুরী তার 'অপরাধ ১৯৭৫' কবিতায়। হন্তারকদের কাছে জীবিত মুজিবের থেকে মৃত মুজিবের লাশ হয়ে উঠেছিল বেশি ভারী। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর মুজিবভক্তরা ভিড়ে গিয়েছিল সুবিধাবাদীদের দলে। আগের সব নৈতিকতা আর আদর্শ ভুলে যোগ দিয়েছিল হন্তারকদের দলে। আবদুল গাফফার চৌধুরী এদের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন করে বলেছেন- ক. কোথায় তোমার মুক্তিযোদ্ধা? বাঘা সিদ্দিকী? কর্মী বাহিনী? কোথায় তোমার বুদ্ধিজীবীরা? তারা তো এখন ক্ষমতা কামিনী, কেউ ঘরে বসে নেতা হতে চায় বিদেশে কেউবা আবাস জমায় গলাবাজি আর মায়াকান্নায় দেশে বাতাস পীড়িত জনতা ভ্রান্ত : তোমার পতাকা মাটির ধুলায় নমিত। [বঙ্গবন্ধু, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী] খ. মহান মানব ছিলে তুমি- দেবতা তো কখনো ছিলে না দেবতা বানিয়ে যারা স্তুতি করেছে তোমার জনসভা সেমিনারে বহুবার জীবন দিয়েছে তোমার মৃতু্যর পরে তারা কেউ আমাদের সঙ্গে নেই আজ সেবাদাসীদের মতো তারা সব ঘিরে আছে নতুন মনিব হায়! এ রকম অপকর্ম শুধু বুঝি বাঙালির সাজে! আমাদের জাতিসত্তা প্রেম আর ঐতিহ্যের হাজারো কাহিনী ভুলে গিয়ে তারা সব বিদেশের সেবক হয়েছে! [টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে, কামাল চৌধুরী] এটাই স্বাভাবিক, কেননা, বাঙালি বিশ্বাসঘাতক আর সুবিধাবাদী। বঙ্গবন্ধুর তোষামোদকারীরা বিশ্বাস ভেঙে অকৃতজ্ঞ হয়ে ভিড়েছিল হন্তারকদের দলে।

হন্তারকরাও বাঙালির মতো, তাদের ভাষাও বাংলা, মানুষের মতো দেখতে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথাও হয়েছে, তারা ছিল তার ঘনিষ্ঠও। অথচ মানুষের মতো দেখতে মানুষরাই তাকে হত্যা করেছে। শহীদ কাদরী তাই বলেন, 'এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর / শুনিবো না কোনো দিন' (হন্তারকদের প্রতি)। হন্তারকদের কবিরা ক্ষমা করতে চান না। আবার কেউ কেউ শাস্তিও দিয়েছেন। করেছেন ঘৃণা। দিয়েছেন থু থু। হত্যাকান্ডের পর কালোত্বে ঢেকে যায় দেশ ও আচার-বিচার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জয় বাংলা, ধর্মনিরপেক্ষতা, একুশে ফেব্রম্নয়ারি ও বাংলাভাষাকে তারা হত্যা করতে চেয়েছে। তোমাকে হত্যার পর ধসে গেছে মুক্তিযুদ্ধ : মূল চার নীতি ধসে গেছে মানবিক মূল্যবোধ আর মুক্তিচিন্তা- স্বাধীনতা গণতন্ত্র চলে গেছে অস্ত্রের দখলে আর সেনা ছাউনিতে, তোমার শূন্যতা এত ভয়াবহ বুঝিনি তখনো। [তোমাকে চিনিনি বহুদিন, নাসির আহমেদ] স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং হত্যাকান্ডের তুলনামূলক চিত্র নির্মাণে দারুণ এক বিন্যাস দেখিয়েছেন সিকদার আমিনুল হক। স্বদেশে ফিরবে বঙ্গবন্ধু সেজন্য মানুষের অপেক্ষা, আবার পঁচাত্তরের হত্যাকান্ডের পর তার লাশের জন্য অপেক্ষা করে মানুষ। কবি দারুণ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন 'তোমার অপেক্ষায় ছিল সবাই' কবিতায়- ক. 'একমাত্র তোমার অপেক্ষায় ছিল শতকোটি মানুষের / চোখ, স্বপ্ন আর সুদিনের অপেক্ষায় কাতর / বাংলার এতগুলি দীর্ঘশ্বাস'! বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই অপেক্ষা। আবার খ. 'অন্যেরা সেনানিবাসের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে / তোমার রক্তাক্ত সাহসী শবের জন্য অপেক্ষা করছিল...'। গ. 'আমি বুঝি না অপেক্ষা শব্দটি একইসঙ্গে / কত সুন্দর ও জঘন্য হতে পারে'! এরপর বঙ্গবন্ধু যে বাড়িতে থাকতেন ওই বাড়ি নিয়ে কেউ কেউ লিখেছেন কবিতা। ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি নিয়ে লিখেছেন- বেলাল চৌধুরী, মনজুরে মাওলা, ফারুক আলমগীর, ফারুক মাহমুদ, শিহাব শাহরিয়ার। কবিরা বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে চান প্রেরণা নিতে, অরাজকতার অবসানে বঙ্গবন্ধুকে আবারও ফিরে চান। এমন প্রেক্ষাপটে লিখেছেন- মাহবুব উল আলম চৌধুরী, ফজলুল হক সরকার, কামাল চৌধুরী, তুষার দাশ। ব্যক্তি মুজিবের উদারতা, নিঃস্বার্থবাদিতা, দেশের জন্য ভালোবাসা, বিশ্বাসী মুজিব এমন বিষয়ে লিখেছেন- শামসুল ইসলাম, রবিউল হুসাইন, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, হারিসুল হক। আবার বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ, তর্জনী, বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত পাইপ নিয়েও কেউ কেউ লিখেছেন। তার সব কিছু যে এখন সংরক্ষিত জিনিস হিসেবে রয়েছে সে কথাও লিখেছেন কবি। আর বঙ্গবন্ধু তো আমাদের সত্তার সঙ্গে মিশে আছেন। তার অনুপস্থিতি নেই। তিনি সব সময় বর্তমান- ক. তিনি আছেন- নদীর কলতানে পাখির কাকলিতে শিশুর কলরবে আকাশের নীলে পাতার সবুজে চাঁদের আলোয় সূর্যের কিরণে [বঙ্গবন্ধুর নকশিকাঁথার মাঠ, জরিনা আখতার] খ. কে বলে মুজিব নাই? জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সদা বিদ্যমান আঁধারবিনাশী আলো- বাঙালির জাত্যপরিচয়ও : তারই অস্তিত্বের গান- [সদা বিদ্যমান, রহমান হেনরী] বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব কখনোই নষ্ট হওয়ার নয় কিংবা ক্ষয়ে যাওয়ার নয়। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে যাবেন। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে এমন নানা আখ্যানই রচিত হয়েছে গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোয়।

এ কথাগুলো আমার নয়, আমার সংগৃহীত কথাসাহিত্যিক হারুন পাশার বই থেকেই নেয়া হয়েছে। তবে আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এই দিনে দৃঢ়তা নিয়েই বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের অমর কাব্য ও কবিতার নাম। সেই শীতের সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধু একাত্তরের মার্চের পরে প্রথমবারের মতো জাতির উদ্দেশে কথা বলেন। জাতি আগ্রহভরে শ্রবণ করে তার প্রাণ থেকে উঠে আসা কথামালা, যা তারা সবসময়ই করেছে। আবেগে তার গলা ধরে আসছিল, তবে তার বাগ্মী প্রকাশে তা কাটিয়ে যাচ্ছিল। আবারও জাতি একাগ্র আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন বঙ্গবন্ধুর জাগানিয়া স্লোগান ‘জয় বাংলা’।

বইছিল স্বাধীনতার সুবাতাস। স্লোগানে মুখরিত চারদিক, আকাশ-বাতাস। জোর গলায় উচ্চারিত হচ্ছে, ‘জয় বাংলা’, তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরজুড়ে যেন অনুরণিত হয়ে চলেছে, প্রতিধ্বনিতে একাকার। হালকা শীতের আমেজময় সেই ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। বেলা দ্বিপ্রহরের পরপরই হাজার দশেকেরও বেশি সদ্য মুক্তির স্বাদ পাওয়া আবেগে উদ্বেলিত বাঙালি সেখানে জড়ো হয়েছিল, যদিও তারা জানতেন জাতির পিতা সেখানে এসে পৌঁছবেন বিকেলে।

রুদ্ধশ্বাসে সেখানে প্রতীক্ষায় রয়েছেন সবাই, প্রতীক্ষায় সেই মহানায়কের, যিনি এই মাটির স্বাধীনতা এনেছেন, যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আর উদাত্ত আহ্বানে সবাই নেমেছিলেন মুক্তি ছিনিয়ে আনার যুদ্ধে। শত ত্যাগ তিতিক্ষা, অশ্রুপাত, রক্তপাত, মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এনেছেন তারা। সেই মহানায়ককে নিজ দেশের মাটিতে স্বাগত জানাতে তাই এত আয়োজন। অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়ানো লাইনে সবার মুখে উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা যারা যুদ্ধ করেছিলেন, গঠন করেছিলেন যুদ্ধকালীন সেই মুজিবনগর সরকার। তরুণ ছাত্রনেতাদের মধ্যেও আবেগ। সবাই তাদের হৃদয়ের বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষায়।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা কমেট বিমানটি যে মুহূর্তে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করল, যেন কোনো জাদুময় কিছু ঘটে গেল। প্রতীক্ষাধীন লাখো জনতা যেন অপেক্ষা করে ছিল অনন্তকালের জন্য, তার সমাপ্তি ঘটল। শেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

বঙ্গবন্ধু তার নতুন মহিমায় এলেন, এ যেন, ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা’। ‘ভদ্র মহোদয়গণ আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, আমি জীবিত এবং সুস্থ’, বাংলার সেই নেতা বললেন আনন্দিত স্বরে, নানা মিথ্যা ও অপপ্রচারের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে ‘পাকিস্তানের বন্দি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল তার বন্দিদশার দিনগুলোতে। তিনি দেশে ফেরার দুদিন আগে লন্ডনের ক্লারিজেসে একটি জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। জানুয়ারির ৮ তারিখে পাকিস্তানের নতুন নেতা তাকে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির চাকালা বিমানবন্দরে বিদায় জানান।

বাংলাদেশের উদ্দেশে উড্ডয়নের পর, ভুট্টো মন্তব্য করেছিলেন, ‘দ্য নাইটিঙ্গেল হ্যাজ ফ্লোউন’। অবতরণের পরে বঙ্গবন্ধুকে দেখে মনে হচ্ছিল অনেক ক্লেদাক্ত দীর্ঘ ১০ মাস পাকিস্তানে বন্দিদশায় কাটাবার ক্লান্তির ছাপ। আর উৎসুক জনতার উচ্ছ্বাসে, উল্লাসে আর গগনফাটা জয়োল্লাস ও অভিবাদনে তিনি স্পষ্টতই বিহবল হয়ে পড়েন। তাকে একাত্তরের মার্চে যখন পাকিস্তানে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় সে সময়ের তুলনায় বেশ শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছিলেন। এলোমেলো, উস্কোখুস্কো চুল আর মুখে লেগে থাকা স্মিতহাসি, কপালে লেপ্টে থাকা চুলের মধ্যে তিনি আলতো হাত বুলিয়ে ঠিক করছিলেন। সারা শরীরে অবসাদের চিহ্ন। তবে চোখে দৃঢ় প্রত্যয় আর অদ্ভুত দীপ্তি যা জনতার মনোযোগের কেন্দ্রে।

তিনি কাঁদছিলেন। জনসমক্ষে বা বিশ্ববাসীর সামনে প্রথমবারের মতো ছল ছল অশ্রুসিক্ত। বিগত নয় মাসে বাংলাদেশ ও তার জনগণের উপর যে বীভৎস জুলুম, অত্যাচার গিয়েছে তার স্মরণ করে তিনি কাঁদছিলেন। তার সঙ্গে কাঁদছিল উপস্থিত জনতাও। সাত কোটি জনতা তার নিরাপত্তা নিয়ে এতদিন শঙ্কিত ছিল। তারা এতদিন কত না প্রার্থনা করেছে আবার নিজেদের মাঝে ফিরে পাওয়ার, নিরাপদে ফিরে আসার জন্য।

এর কয়েক ঘণ্টা আগে, তিনি দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভ্যর্থনা লাভ করেন। সাত কোটি বাঙালি প্রত্যক্ষ করলেন তাদের জাতির পিতা রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে গার্ড অব অনার পরিদর্শন করলেন। রেসকোর্সের সেই ঐতিহাসিক স্থান যেখানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল তার অমোঘ ৭ মার্চের উত্তাল ভাষণ।

বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ট্রাকটি ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্সের এই স্বল্পদৈর্ঘের রাস্তাঘাট জনমানুষের সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। মানুষের মনে আনন্দ যেন আর ধরে না। প্রতিটি ছাদের উপরে আনন্দিত মুখের প্রতিচ্ছবি- নারী, পুরুষ আর শিশুর। কিশোর-তরুণরা আশপাশের গাছগুলোতে চড়ে বসেছিল এই জয়োৎসব প্রত্যক্ষ করতে। সবার সংলাপ সীমাবদ্ধ ছিল দুটি সহজ সরল কিন্তু কার্যকর এবং প্রেরণাদায়ক শব্দে।

সেই শীতের সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধু একাত্তরের মার্চের পরে প্রথমবারের মতো জাতির উদ্দেশে কথা বলেন। জাতি আগ্রহভরে শ্রবণ করে তার প্রাণ থেকে উঠে আসা কথামালা, যা তারা সবসময়ই করেছে। আবেগে তার গলা ধরে আসছিল, তবে তার বাগ্মী প্রকাশে তা কাটিয়ে যাচ্ছিল। আবারও জাতি একাগ্র আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন বঙ্গবন্ধুর জাগানিয়া স্লোগান ‘জয় বাংলা’।

সদ্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে বইছিল স্বাধীনতার সুবাতাস। কিন্তু সেই সুবাতাসে বাঙালি জাতি যেন একজনের অভাব বোধ করছিল। বুঝতে দেরি হলো না আসলে সেই অভাবটা। সদ্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে সেদিন এই মহান নেতার অনুপস্থিতি বঞ্চিত করে পূর্ণ সাত কোটি বাঙালির বিজয়ের স্বাদ আস্বাদনে।

ভয়াল ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখে হানাদার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিদ্রোহে উস্কানি দেয়ার অভিযোগে বিচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

জাতির উদ্দেশে দেয়া তার ঘোষণাটি ছিল, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।

বিজয়ের পরপর বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মাটিতে ফিরে পেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে দেশের আপাময় জনসাধারণ। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের দাবি ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান বাঙালি জাতির পিতা।



এদিন বঙ্গবন্ধুকে একটি বিশেষ বিমানে তুলে দেয়া হয় লন্ডনের উদ্দেশে। সকাল সাড়ে ৬টায় তাদের বহনকারী বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বেলা ১০টার পর থেকে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেন।

ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিমানে তিনি পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন। ১০ তারিখ সকালেই তিনি নামেন দিল্লিতে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন।

লন্ডন-দিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। বাঙালি জাতির পিতা তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা।’ তার আগমনে পূর্ণতা পায় মহান স্বাধীনতা। সেই থেকে দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর অন্ধকারে নিমজ্জ্বিত বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন আমাদের আশার বাতিঘর তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বেই দুর্বার গতিতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা সবাই তার পাশে থাকবো, এই হোক আমাদের আজকের শপথ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক:
সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য পিপলস টাইম
সহ-সভাপতি, সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগ
সদস্য, কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
পরিচালক, এফবিসিসিআই
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইরান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]