
পদ্মা নদীর কোল ঘেষে জেগে উঠা ধুধু বালু চর এখন সবুজ ফসলে ঘেরা। চরঞ্চলের নতুন পলি মাটিতে নানা ফসল উৎপাদন করতে বছরের প্রায় নয় মাস ব্যাস্ত সময় পার করে কৃষক। মাঠে ফসল উৎপাদনে কৃষকদের পাশাপাশি কৃষাণীরাও কৃষি কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বীজ রোপণ, ধান, গম মাড়াই, সবজি তোলা, মাঠে ফসলের পরিচর্ষা সহ কৃষি উৎপাদনে সহযোগিতা করছে তারা।
২১নভেম্বর সোমবার বিকাল ৩ ঘটিকায় সরেজমিনে গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মার চর মজলিশ পুর, চর কর্ণেশন, মহিদাপুর কয়েকটি মৌজায় ঘুরে দেখা যায়, শত শত বিঘা জমিতে শীত কালীন সবজি সহ নানা ধরনের ফসল উৎপাদন করছে কৃষক, তাদের কাজে সহযোগিতা করছে কৃষাণীরাও। অনেকেই নিজের জমি না থাকায় অন্যর জমিতে দিন হাজিরা ( কৃষি শ্রমিক) হিসাবে কাজ করছে।
কেমেলা বেগম (৪০)। দুই সন্তানের জননী। ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের দৈনিন্দন কাজ শেষ করে। সন্তানদের স্কুলের পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এর পর মাঠে গিয়ে স্বামীর সাথে তাল-মিলিয়ে কাজ করেন ফসল উৎপাদনে। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আবারও শুরু করেন রান্নাবান্নার কাজ। বর্ষা মৌসুম ছাড়া এ ভাবেই প্রতিদিন স্বামীর সাথে কৃষি কাজে সহযোগিতা করেন তিনি।
কমেলা বেগম বলেন, স্বামী একা কাজ করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। কৃষি শ্রমিকের মুজুরি দিয়ে কাজ করানো পরিবর্তে আমি সেই কাজ করে দেই। চরের জমিতে টমেটো ও উস্তা চাষ করেছি। এখন উস্তা তুলে বাজারে বিক্রি করছি। নিজের কাজ নিজেরাই করি, এতে লজ্জার কিছু নেই। প্রয়োজনের তাগিদে পুরুষদের পাশাপাশি কৃষি কাজ করি। এখন কৃষি কাজ করতে খারাপ লাগে না। তবে অনেক কষ্ট হয়। পরিবারের দৈনিন্দন কাজ করে কৃষি কাজ করতে হয়। নারীদের ঘরে বসে না থেকে পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করার জন্য এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
তিনি আরোও বলেন, ২বিঘা জমিতে উস্তা ও ২ বিঘা জমিতে টমেটো লাগিয়েছি। অতি বৃষ্টিতে ১বিঘা জমির উস্তা নষ্ট হয়েছে। অন্য ১বিঘা জমিতে উস্তা খুব ভাল হয়েছে। বাজারে উস্তার দাম ভালো। আশা করি নষ্ট হয়ে যাওয়া উস্তার ক্ষতি উঠিয়ে লাভ হবে।
উজান চর ইউনিয়নের চর মহিদাপুর মাঠে কৃষক আমজাদ দেওয়ান স্ত্রী রাশেদা খাতুন কে নিয়ে ধনিয়া পাতা উত্তোলন করছে সাথে পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী শ্রমিক কাজ করছে মাঠে। আট থেকে দশ জন শ্রমিক এক সাথে কাজ করছে। তিনি বলেন, পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি সকল কাজ করতে পারে নারী শ্রমিকেরা, শুধু ভারী বোঝা বহন করতে পারেনা। তাই তাদের মুজুরী একটু কম দেওয়া হয়।
দিন মুজুরী কৃষি শ্রমিক হিসাবে মাঠে কাজ করছেন শাহেদা বেগম ( ৪৫) বলেন
নদী ভাঙনের কারণে সব কিছু হারিয়েছি। অর্থ কষ্টে জীবন-যাপন করতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে এই বয়সে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষি কাজ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, পুরুষের সাথে কাজ করতে কোন সমস্যা নেই। তবে পুরুষের সাথে সমান কাজ করেও মজুরী তাদের অর্ধেকের চেয়ে কম। যেখানে পুরুষ কৃষক মজুরী পায় ৫/৬শত টাকা। আমরা পাই ৩/৪ শত টাকা। প্রতিবাদ করলে কর্ম হারাতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তিনি দুঃখ করে আরোও বলেন, কৃষি কাজ করে পুরুষের সমান হাজিরা পেলে আরোও অনেক নারী শ্রমিক কৃষি কাজে আগ্রহী হবেন। সুতরাং নারীদের কৃষি কাজে আগ্রহী হওয়ার জন্য মুজুরী পুরুষের সমান করতে হবে।
চর কর্ণেশন আংকের শেখের পাড়ার গ্রামের নাদের শেখের স্ত্রী কদভানু বেগম-(৫৫)। বলেন, পূর্বে ধোপাগাথী এলাকায় স্বামী বাড়ীর ৭/৮ বিঘা কৃষি জমি ছিল। নদী ভাঙনের কারণে এখন কোন জায়গা জমি নেই। ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে এবং অসুস্থ্য স্বামী। এখন নিজের থাকার জন্য কোন জায়গা-জমি নেই। বাধ্য হয়ে অন্যের জায়গা লিচ নিয়ে কোন রকম ঘর তুলে বসবাস করছি। অসুস্থ্য স্বামী কোন কাজ-কর্ম করতে পারে না। তার পরও মাঝে মধ্যে অসুস্থ্য শরীর নিয়ে কৃষি কাজ করেন। সংসার চালানো তাগিদে কৃষি কাজ করতে হয় তাকে।
গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোকন উজ্জামান জানান, গোয়ালন্দ উপজেলায় অনেক নারী কৃষি শ্রমিক আছে। তারা কৃষি কাজে পুরুষের চেয়ে অনেক সফল। অনেক নারী কৃষক আছে অন্যের জমিতে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করেন। এসকল নারীদের উৎসাহ তৈরি করতে পুরুষের সমান মজুরী করা প্রয়োজন। ভালো ফসল উৎপাদনে ভবিষ্যতে নারী শ্রমিকেদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।