
এটা ঠিক যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিষয়ের পাঠ্যক্রমে সংশোধন প্রয়োজন। পাঠ্যক্রম আধুনিক করতে হবে—এটাও ঠিক; কিন্তু সেটা যেন পশ্চিমা ধাঁচে না হয়। সমকালীন বিশ্বের বাস্তবতা আছে, তার কিছু প্রতিফলনও আমাদের দেখাতে হবে। সে কারণে ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, কোরিয়াসহ প্রতিবেশী দেশগুলো কীভাবে অগ্রসর হচ্ছে, সেটাও দেখতে হবে। কারণ, তারা অনেকটাই ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার একটা সুন্দর সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলেছে। এ জন্য ১০ বছরের একটা পরিকল্পনা দিলে ভালো হয়।
পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থারও উন্নয়ন দরকার। কারণ, সেখানে উন্নয়ন না হলে ছেলেমেয়েরা উৎসাহ পাবে কোথায়?
এরপর দেখতে হবে চাকরির বাজার ঠিক আছে কিনা। আমরা আইসিটি নিয়ে কথা বলছি; কিন্তু আইসিটির বাজার কি তৈরি করতে পারছি? এক দিনে আমি লাফিয়ে ছাদে পৌঁছে যাব—এমন চিন্তা না করে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া উচিত।
সাবজেক্ট রিলেটেড জব পৃথিবীর কোথাও নেই। কিন্তু এখন প্রতিটি বিষয় বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়। সেজন্য অনেকে আরবি, সংস্কৃত, দর্শন ও পালি বিষয়গুলো বাদ দিতে চায়। একটা বিশ্ববিদ্যালয় তাহলে চলবে কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয় কি শুধু বাজার করা শেখাবে? বিশ্ববিদ্যালয় যে কোনো বিষয়ই পড়াতে পারে। এটা তার স্বাধীনতা। এটা পড়াবেন, ওটা পড়াবেন না—বাইরে থেকে এ ধরনের নির্দেশনা দিয়ে আমরা মুক্তচিন্তার প্রথম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে ফেলি। বাজারকে সেখানে বসিয়ে দিই, এটা ঠিক না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম সংস্কারের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আছে। প্রথমত, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের মডেল হলো আমেরিকা। আমেরিকার মডেলে পড়াশোনা আমাদের জন্য খুব একটা উপকারী মনে করি না, যদি না আমাদের তাদের মতো সম্পদ থাকে। ধরে নেওয়া হয়, পশ্চিমা মডেলে আমাদের তৈরি হতে হবে বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার জন্য। তাদের মতো সম্পদ আমাদের নেই, আবার তাদের মতো শিক্ষাকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি কিনা, সেটাও দেখতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অল্প টাকায় চলে। বেতন-ভাতায় বেশিরভাগ টাকা চলে যায়।
শিক্ষার বাজেট এখনো জিডিপির ২.১ শতাংশ। এ বাজেট দিয়ে আমি যদি আইসিটি করি, কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? আরবি, সংস্কৃত বা অন্য বিভাগে আইসিটির ভূমিকা কী? হ্যাঁ, আমরা আইসিটির মাধ্যমে সংস্কৃত শিক্ষাকে উন্নত করতে পারি; কিন্তু সেজন্য যে গবেষণা প্রয়োজন, ছেলেমেয়েদের সক্ষমতা প্রয়োজন, সেটাও তো গুরুত্বপূর্ণ।
তাই বিশ্ব মানেই শুধু পশ্চিম—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা নিউ লিবারেল এডুকেশনের একটা সমস্যা যে, বাজারভিত্তিক শিক্ষা দিতে হবে। আরবি, সংস্কৃত, দর্শন—এগুলো তো বাজারের বিষয় নয়। বাজার দিয়ে যাচাই করলে তো শিক্ষার উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। আরবি, সংস্কৃত, দর্শন—এগুলো এতদিন যেভাবে পড়াচ্ছে, তার সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে সংস্কার করব, সেটাও তো দেখিয়ে দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য একাডেমিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান করছেন। আমিসহ পাঁচজন অবসরে যাওয়া শিক্ষককে এতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সব বিভাগের সঙ্গে আমরা নিয়মিত বসছি। এরপর অ্যালামনাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে বসব। ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্ল্যান আমাদের দিতে হবে। সবাই মিলে যে প্রস্তাবনা দেবে, সে অনুযায়ী আমরা একাডেমিক প্ল্যান সাজাব।