দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক, আওয়ামী লীগ নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ স. ম আলাউদ্দীনের ৭৯তম জন্মদিন আজ। ১৯৪৫ সালের ২৯ আগস্ট তিনি তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের মিঠাবাড়ি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে সরুলিয়া হাইস্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন।
১৯৬২ সালে তিনি কলারোয়া হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬৪ সালে সাতক্ষীরা কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৬৭ সালে দৌলতপুর বিএল কলেজ থেকে বিএ ও ১৯৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬২ সালে হামাদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে আগমন করেন তিনি।
১৯৬৫-৬৮ পর্যন্ত খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতিসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় আন্দোলন সংগ্রামের কারণে তার বিরুদ্ধে একাধিকবার গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ও একাধিক কলেজ থেকে ফোর্সটিসি প্রদান করায় তার শিক্ষা জীবন বিঘ্নিত হয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে খুলনা ল’ কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তার নেতৃত্বে তালা থানা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয় এবং তিনি কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬৭ সালে বি.এ পাশ করে তালার জালালপুর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করলেও রাজনীতির প্রতিটি কর্মকান্ডে দক্ষ সংগঠক হিসেবে জানান দেন স. ম আলাউদ্দীন। ৬৯-৭০’র উত্তাল গণআন্দোলনে স.ম আলাউদ্দীন ছিলেন সাতক্ষীরার তরুণ আন্দোলনকারীদের প্রাণ পুরুষ। উত্তপ্ত রাজপথের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দুর্জয় তরুণ স. ম আলাউদ্দীন ওই সময়ই সাতক্ষীরার গণমানুষের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তানের সর্বকনিষ্ঠ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের নিবর্তনমূলক আইনে স. ম আলাউদ্দীন গ্রেপ্তার হন। ছয় মাস কারাভোগ শেষে মুক্তির তিন মাস পর তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘ দিন সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শূণ্যতা বিরাজ করতে থাকে। এক পর্যায়ে ১৯৮১ সালে স.ম আলাউদ্দীন পুনরায় আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নিয়ে জেলার গ্রামে গ্রামে সংগঠন গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। এসময় অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮৩ সালে স. ম আলাউদ্দীন সাতক্ষীরা শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৪ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। এসময় তারই নেতৃত্বে জাতীয় শ্রমিক লীগ সংগঠিত হয়। তিনি শ্রমিক লীগের জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন।
নব্বই এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় হরতাল চলাকালে তার উপর পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেচে যান। কিন্তু হুলিয়ার কারনে তিনি দীর্ঘ সময় পালাতক থেকে আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত করতে ভূমিকা পালন করেন। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে অসংখ্যবার তার বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে। সামরিক সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘদিন তার বাড়ির টেলিফোন সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়।
স.ম আলাউদ্দীন ছিলেন সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি, ভোমরা স্থল বন্দর ব্যবহারকারী সমিতির সভাপতি, সাতক্ষীরা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের সভাপতিসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। নব্বই এর দশকের শুরুতে দেশব্যাপী মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি কর্মমূখী শিক্ষার নিজস্ব ভাবনা থেকে সাতক্ষীরাতে প্রথম বঙ্গবন্ধুর নামে ‘বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক স্কুল ও কলেজ’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি ঐ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন।
গত ১৯ জুন ২০২৩ স.ম আলাউদ্দীদের ২৭তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে প্রথমবারের মত স.ম আলাউদ্দীনকে নিয়ে প্রকাশিত হয় স্মারকগ্রন্থ “দীপ্ত আলাউদ্দীন”। স্মারকগ্রন্থটি মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এসময় থেকে তার রাজনৈতিক জীবন, গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে অজানা নানা তথ্য প্রকাশ হতে শুরু করে। বই প্রকাশের সময়ই পাওয়া যায় স. ম আলাউদ্দীনের নিজ লেখা তার মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক জীবনবৃত্তান্ত।
স. ম আলউদ্দীনের জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে নিজেই লিখেছেন এভাবে-
১৯৬২: হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে আগমন। ১৯৬৪: ছাত্র রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে বংগবন্ধুর সুমহান সান্ধিধা লাভ। সম্মিলিত বিরোধী দলসহ জিন্নাহ এর নির্বাচনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ।
১৯৬৫-১৯৬৮: খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও বিভিন্ন পদে থেকে ৬-দফা আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় থাকি, কয়েকবার আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরওয়ানা এবং একটি কলেজে ভিপি পদপ্রার্থী থাকাকালেসহ চারটি কলেজ থেকে ফোসটিসির এর কবলে পড়ি এবং কয়েক শিক্ষা বৎসর পিছিয়ে পড়ি।
১৯৬৮-১৯৬৯: খুলনা ল কলেজে অধ্যায়নরত থাকাকালে তৎকালীন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব আব্দুল আজিজের আদেশে সবুর খানের রাজনৈতিক জন্মভূমি, মুসলীম লীগের দুর্ভেদ্যঘাটি তালা থানার আওয়ামী লীগ গঠন করি এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। এতদসত্বেও খুলনাতে ৬৯ ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের একজন প্রথম সারির নেতা হিসাবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করি।
১৯৭০: বঙ্গবন্ধু তালা কলারোয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দান করেন। মূলত: ছাত্র রাজনীতিতে আমার দীর্ঘ অবদান ও নিপীড়ন সহ্য করার কারনে এবং সবুর খানের প্রবল বিরোধীতায় অবতীর্ণ হই। আমার প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আগমনের ফলে সবুর খান ঐ এলাকায় সম্পুর্ন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং অবশেষে নানা খোড়া অজুহাত সৃষ্টি করে গোটা নির্বাচন থেকে নিজের দলকে গুটিয়ে নেয়। বঙ্গবন্ধু আমার এলাকায় দুটি বিশাল নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দান করেন। আমি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হই। জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী এক চতুর্থাংশ ভোট পেয়ে নিকটতম থাকে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ইয়াহিয়া ভুট্টোর বিরোধী সকল কর্মকান্ডে সাতক্ষীরা খুলনাতে অত্যন্ত সফল ও দু:সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করি।
১৯৭১: ২৯ মার্চ আমি ভারতে প্রবেশ করি এবং তৎকালে বিএসএফ এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি মেজর জেনারেল আরুন মুখার্জী এর সাথে বেনাপোল ও ভোমরা সীমান্ত দিয়ে যশোর ও খুলনায় যুদ্ধরতদের অস্ত্র ও অস্ত্রের রসদ সরবরাহের চুক্তি করি এবং দেশে ফিরে আসি। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত সর্বাত্মক প্রতিরোধ এ অংশ করেও পাকিস্তানী দানবীয় যুদ্ধ যন্ত্রের কাছে আপতত: পরাস্ত হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করি।
চাকুলিয়াতে দীর্ঘ ৬ সপ্তাহের ট্রেনিং গ্রহণ করে নিজে নির্বাচিত এমপি হওয়া সত্বেও একজন কমিশন্ড অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। কিছু দিন ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন মাহবুবের অধীনে সেক্টর কমান্ড এর দায়িত্ব পালনের পর সাতক্ষীরা মহাকুমা মুক্তি বাহিনীর প্রধান এর দায়িত্ব প্রদান করে ৮নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর আমাকে দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করেন এবং ৭ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত হওয়া পর্যন্ত দেশের মাটিতে একটি বিশেষ দুর্ভেদ্য ঘাটিতে যুদ্ধরত ছিলাম। আমি ক্যাপ্টেন সায়ফুল্লাহ নাম গ্রহণ করে দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধে অংশ করি। যে নাম ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
আমার নির্বাচনী এলাকাতেই মুক্তিবাহিনীর খুলনা জেলার প্রধান দপ্তর ও মওজুদাগার ছিল। মুক্তি বাহিনীর মহকুমা প্রধান ছাড়াও মনি ভাই, তোফায়েল ভাইদের নেতৃত্বে গঠিত মুজিব বাহিনীর আমি খুলনা জেলা সংগঠক ছিলাম এবং আমার নির্বাচনী এলাকাতেই মুজিব বাহিনীর প্রধান দপ্তর ছিল। আমার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও সমন্বয়ের ফলে খুলনা জেলায় কখনও এই দুই বাহিনীর মধ্যে কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
দীর্ঘ যুদ্ধকালে আমার নেতৃত্বে হানাদার সেনাবাহিনী ও দেশের রাজাকারদের সাথে ছোট বড় বহু যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ২/৩টি ছাড়া আমরা সব কটিতে জয়লাভ করলেও আমার বন্ধু সাথীর প্রাণের মূল্যে তা অর্জিত হয়। ব্যক্তিগত ভাবে আমি চার বার খুব অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা পাই। যুদ্ধে অংশ গ্রহণ এর কারনে সামরিক আদালত আমাকে ১৪ বৎসর সশ্রম কারাদন্ড প্রদান, এমপিএ পদ বাতিল ও সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। আমাকে ধরিয়ে দিলে চল্লিশ হাজার টাকা পুরুস্কার ঘোষণা করে সমস্ত এলাকাতে মাইকযোগে প্রচার দেয়া হয়।
১৯৭২: এক সাগর রক্ত পেরিয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে বারবার ফিরে এসে সংগঠিত হলো স্বাধীন মুক্ত বংঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। যে সব স্থানীয় নেতৃবৃন্দ যুদ্ধে থেকে নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন তাদের গণ-বিরোধী ও দুর্নীতিমূলক কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি তাদের বিরাগভোজন হয়ে একা হয়ে যাই। ছাত্র গণ অভুত্থানের ও মুক্তিযুদ্ধের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা আমার বাড়িতে সাক্ষাৎ করাকে কেন্দ্র করে আমার বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ এবং আমাকে বহিস্কার এর প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। আমি নিজেকে অত্যন্ত অসম্মানিত মনে করে ও ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে এমপিএ পদ ও দল থেকে পদত্যাগ করি। পরে জাসদ গঠিত হলে সেখানে যোগদান করি।
১৯৭৩: জাসদ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি এবং ঐ সময়েও প্রায় পনেরো হাজার ভোট লাভ করি এবং আমার একজন সাথী মুক্তিযোদ্ধা ঐ এলাকাতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তা নাহলে আমার জয়লাভ সম্ভব না হলেও ২৫/৩০ হাজার ভোট পেতাম।
১৯৭৫: সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর বীরোচিত সাহাদাৎ বরণের পর ১৬ ডিসেম্বর ৭৫ জিয়ার সামরিক সরকার আমাকে নিবর্তনমূলক আইনে আটক করে। ছয় মাস কারাগারে থেকে ছাড়া পাবার তিন মাস পরে পুনরায় অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আটক করে। অবশ্য কয়েক দিন পরে তৎকালিন জিসিএম মেজর জেনারেল মঞ্জুর এর হস্তক্ষেপে মুক্তি লাভ করি।
১৯৭৯: সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি জাসদ হতে, কিন্তু সবুর খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এর বিপুল পুনরুত্থান দেখে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াই এবং পরবর্তীতে জাসদ এবং রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করি।
১৯৮১: আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে এ সময় তালা ও সাতক্ষীরাতে এক চরম শুন্যতা ও হতাশা বিরাজ করছিল, এসময়ে যাদের নিয়ে আমি এক যুগ আগে আওয়ামী লীগ সংগঠিত করছিলাম সেই সব নেতা ও কর্মীদের ঐকান্তিক আগ্রহে পূনরায় আওয়ামী লীগ এ যোগদান করি। ড. কামাল হোসেন সাহেবের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ প্রতিটি আন্দোলনে ও কর্মকান্ডে আমি মুখ্য ভুমিকা পালন করতে থাকি।
১৯৮৩: সাতক্ষীরা শহর আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও পরবর্তীতে সভাপতি নির্বাচিত হই।
১৯৮৪: জেলা আওয়ামী লীগের সংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হই। জাতীয় শ্রমিকলীগ বাংলাদেশ সংগঠিত করি এবং জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হই।
১৯৮৬: আমার এলাকায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী প্রতিনিধি হিসাবে নিজ অর্থ ব্যয়ে নির্বাচনে বিজয় লাভ হয়।
১৯৮৭: স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করি এবং সাতক্ষীরার আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে পুলিশ একমাত্র আমার বাড়িতে বারবার হানাা দেয়। একদিনের হরতাল চলাকালে সরকারী গুন্ডা বাহিনীর দ্বারা অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে আমি আহত হই এবং অল্পের জন্য আল্লার রহমতে আমার প্রাণ রক্ষা হয়।
১৯৯৩: স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণ অভ্যুত্থানে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করি এবং প্রায় একমাস কাল স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারি নাই। প্রতিদিনই পুলিশ আমার বাড়িতে হানা দিত এবং আমি এক স্থান হতে অন্য স্থানে করে আন্দোলন পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করতাম। জরুরী অবস্থা জারী হওয়ার রাত থেকেই আমার টেলিফোন লাইনগুলো বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় এবং স্বৈরাচার পতন না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন থাকে।
স্বৈরাচার পতনের পূর্বে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে তালা থানা এলাকার অংশগ্রহণ করি। নিকটস্থ বিএনপি প্রার্থীর চেয়ে প্রায় নয় হাজার ভোট এগিয়ে থাকার পরও ষড়যন্ত্র ও ভোট ডাকাতির মাধ্যমে জাতীয় পার্টির প্রার্থী যিনি আমার চেয়ে পনেরো হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিলেন তাকে ৫৯০ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। সম্ভাবত এই জীবন বৃত্তান্তটি ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচন পূর্ব সময়ে লেখা। এর মাত্র কয়েকদিন পর ১৯ জুন তিনি ঘাতকের গুলিতে নিহত হন।
স.ম আলাউদ্দীন সম্পর্কে বৃহত্তর খুলনার মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান, বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু দীপ্ত আলাউদ্দীন স্মারকগ্রন্থে লিখেছেন, “স. ম আলাউদ্দীন ছিলেন একজন সরল সোজা মানুষ। কূটচালের রাজনীতি পছন্দ করতো না। সে সামনা-সামনি কথা বলতে পছন্দ করতো। কারো সমালোচনা করলেও সামনা-সামনি করতো, আবার কারো প্রশংসা করলেও সামনা-সামনি করতো। পিছনে সমালোচনা করতো না। স. ম. আলাউদ্দীনের একটা বড় গুণ ছিলÑ রাজনীতির জন্য যে খরচ হতো তা নিজের পকেট থেকেই ব্যয় করতো। কারো কাছ থেকে চাঁদা তুলে সে রাজনীতি করতো না। নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের টাকা থেকেই দলীয় কাজে খরচ করতো। নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে সে একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিল।”
তিনি আরো লিখেছেন, “স. ম আলাউদ্দীন জনগণ এবং সাতক্ষীরার উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন। আমি একবার কোলকাতায় গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য। সেখানে আলাউদ্দীনের সঙ্গে দেখা হলো। দেখলাম ওর কাছে বড় একটা ফাইল। জিজ্ঞেস করলামÑ কোথায় যাবা? ও বললো, দিল্লি যাবো। আমি বললাম, কেন? ও বললো, ভোমরাকে আন্তর্জাতিক বন্দরে রূপান্তরিত করতে হবে। এটা না করলে সাতক্ষীরার উন্নয়ন হবে না। তার মধ্যে এমনই বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, ভোমরার যদি উন্নতি হয়, তাহলে সাতক্ষীরার উন্নতি হবে। আমরা কলকাতার একই হোটেলে ছিলাম। এরপর সে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে দিল্লি যায়। আমি তাকে বলেছিলাম- এসব না করে রাজনীতি করতে। ও খুব জেদি ছিল। দুরন্ত সাহস ছিল স. ম আলাউদ্দীনের। আমিও পরে বুঝেছিÑ ভোমরা বন্দরের সাথে সাতক্ষীরার উন্নয়নের যোগসূত্র রয়েছে।”
শেখ কামরুজ্জামান টুকু আরো লিখেছেন, “স. ম আলাউদ্দীন ছিল বন্ধু বৎসল একজন সরল মনের মানুষ। কর্ম চঞ্চল ছিল। মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কোনো কাজকে সে ফেলে রাখতো না। একটু জেদিও ছিল। সাহসী তো বটেই। কাজ আদায় না করে সে ঘরে ফিরতো না। তার খোলামেলা স্বভাব ও প্রকাশ্যে কথা বলাটা অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারেনি। রাজনীতিতে একটু কৌশলী হওয়ার যে বিষয়টি আছে, সেটি তাঁর মধ্যে ছিল না। আমি তাকে কখনো দুর্নীতির সাথে জড়িত হতে দেখিনি। সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুব নিবিড়।”
মাত্র ৫১ বছর বয়সে ১৯৯৬ সালের ১৯ জুন নিজ প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রদূত অফিসে কর্মরত অবস্থায় ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারান স.ম আলাউদ্দীন। এই হত্যা মামলার চার্জশীটভূক্ত আসামী সাতক্ষীরার আলিপুরের আব্দুস সবুর, শহরের প্রাণসায়র এলাকার খলিলুল্লাহ ঝড়ু, তার ভাই সাইফুল্লাহ কিসলু (বর্তমানে মৃত), তার আর এক ভাই মোমিন উল্লাহ মোহন, শহরের সুলতানপুরের এস্কেন্দোর মির্জা, একই এলাকার কাজী সাইফুল ইসলাম, শহরের প্রাণ সায়র এলাকার সফিউর রহমান, কামালনগরের আবুল কালাম, তার ভগ্নিপতি তালার নগরঘাটার আব্দুর রউফ এবং পালাতক আসামী আতিয়ার রহমান। মামলাটির বিচার কাজ আজো শেষ হয়নি।