
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে শূন্যকোটা পূরণে বছরব্যাপী নিয়োগদান প্রক্রিয়া চালিয়েছে অধিদফতর। এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার অধীনে বেশ কয়েকটি পদে প্রায় সহস্রাধিক প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। তবে নিয়োগ কমিটির সভাপতি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শামছুল হক ভুইয়া ও সদস্য সচিব নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন ইসলামের নামে অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী বরাবরে জমা পড়েছে তিনটি অভিযোগ। ক্লার্ক কাম-টাইপিস্ট পদে আনারুল ইসলাম তার আবেদনে লেখেন তিনি জনস্বাস্থ্য অধিদফতরে গত ৩ বছর ধরে খণ্ডকালীন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মুদ্রাক্ষরিক পদে জিপিএস-১ প্রকল্পে কর্মরত।
এ প্রকল্পের কম্পিটারের সব কাজ তিনি একাই করে থাকেন। কিন্তু ক্লার্ক কাম-টাইপিস্ট পদে এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহারিক পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়া হয়। একই অভিযোগে মনিরুজ্জামান মনির ও ইমরুল কায়েস নামের আরো দুজন পৃথক দুটি অভিযোগ করেন। অভিযোগে প্রধান প্রকৌশলী মহোদয়ের স্মারক নং-১০৮২, তারিখ- ২০/০৯/২০১৮ উল্লেখ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জনস্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারা নিয়োগ কমিটির প্রতিক্ষোভ প্রকাশ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা ও কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, জনস্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একনেতা এই নিয়োগ নিয়ে অধিদফতরে দৌড়ঝাঁপ করছেন। লিখিত পরীক্ষার সময় থেকে তাকে নিয়োগ কমিটির সভাপতির কার্যলয়ে ঘনঘন যাতায়াত করতে দেখা গেছে। এমনকি বিএনপি সমর্থক এই নেতাকে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ফেয়ারওয়েল দিয়ে এ অধিদফতরে নজির স্থাপন করেছেন বলেও জানিয়েছেন তারা। অভিযোগ অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই নিয়োগ কমিটির অধীনে নিয়োগে পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি না হওয়ায় দুই প্রার্থী আদালতে মামলা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা বাবার আহাজারি সমৃৃদ্ধ দু’টি আবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বরাবরে।
উল্লেখ্য, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কোটায়ও চাকরি হয়েছে এক প্রার্থীর। পরে জানা গেছে মুক্তিযোদ্ধা শশুরকে বাবা দেখিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে চাকরি বাগিয়ে নেন তিনি। তবে নিয়োগ কমিটির ভূমিকা কি ছিল এর কোনো সদউত্তর মেলেনি সংশ্লিষ্ট কারো কাছ থেকে। বিষয়টি নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে প্রধান প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম টেলিফোনে সংশ্লিস্ট কর্মকর্তাকে আদেশ দেন তাকে সাময়িক বহিস্কারের জন্য।
নিয়োগে নানান জটিলতা ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নিয়োগ কমিটির সভাপতি শামছুল হক ভুইয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমার কাছে আসেনি।’ যদিও বিএনপি সমর্থিত এক কর্মচারী নেতাকে ফেয়ারওয়েলের বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। লিখিত পরীক্ষা ও ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় কোনো নেতা একাধিকবার তার সাথে দেখা করেছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার সাথে যে কেউ দেখা করতে পারে’।
প্রধানমন্ত্রীর জিরোটলারেন্স নীতি অবলম্বনে জনস্থাস্থ্যের প্রধান প্রকৌশলী এ অধিদফতরকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছেন। জানা গেছে, এর আলোকে তিনি সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রকৌশলীদের শুদ্ধাচার পুরস্কার দিয়ে সততায় অনুপ্রাণিত করেছেন। পাশাপাশি অসৎদের বদলী, তিরস্কারসহ নানাভাবে হেয় করে দুর্নীতি বন্ধে প্রাণপন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন একসময়ে এসে নিয়োগ কমিটির বিষয়ে এমন এক অভিযোগ অধিদফতরের ভাবমুর্তিকে ক্ষুন্ন করছে বলে জানান অনেকে। কর্মচারী ইউনিয়নের এক নেতা বলেন, প্রধান প্রকৌশলী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এ অধিদফতরকে দুর্নীতিমুক্ত করতে কিন্তু কয়েকজন দুর্নীতিবাজের অসৎ চিন্তা ও কাজকর্মে ডিপার্টমেন্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা শুনে আসছি নিয়োগে অনিয়ম হচ্ছে। বিষয়গুলো নিয়ে আমরাও নিয়োগ কমিটির সভাপতির সাথে আলোচনা করি কিন্তু উনি উনার সিদ্ধান্তে অটল’।
প্রধান প্রকৌশলীকে সিবিএ নেতাদের চিঠি :জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ছে প্রধান প্রকৌশলী বরাবরে। প্রধান প্রকৌশলী বরাবরে অভিযোগ জমা দিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের ছয়টি সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।
অভিযোগকারীদের মধ্যে রয়েছেন, বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়নের সভাপতি কবির আহমেদ মজুমদার (জাতীয় শ্রমিকলীগের অন্তর্ভুক্ত), বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়নের সভাপতি মো. আবু তাহের মোল্লা (পেশাজীবী লীগের অন্তর্ভুক্ত), বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস সহকারি সমিতির যুগ্ম আহবায়ক মো. মোফাজ্জল হোসেন, বাংলাদেশ সরকারি গাড়ী চালক সমিতির সভাপতি মো. আবুল কাশেম, বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল মেকানিক ইউনিয়ননের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুর রশিদ ও বাংলাদেশ ১৬-২০ গ্রেড সরকারি কর্মচারি সমিতির সভাপতি মো. জাহিদুল ইসলাম।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে ক্লার্ক-কাম-টাইপিস্ট পদে গত ৩০ অক্টোবর ২০২১ লিখিত পরীক্ষা হয়। মো. আনারুল ইসলাম ও মো. মনিরুজ্জামান নামের দুজন পরীক্ষার্থী ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। ৫ নভেম্বর তাদেরকে কম্পিউটার ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। যথারীতি পরীক্ষা শেষে তাদের রেজাল্টে ফেল দেখানো হয়। উল্লেখ করা হয় আনারুল এই অধিদফতরে জিপিএস-১ প্রকল্পে অফিস সহকারি কাম-কম্পিউটার মাদ্রাক্ষরিক পদে কর্তৃপক্ষের সন্তোস্টিসহকারে খণ্ডকালীন চাকরী করছেন। তাই অন্তুত কম্পিউটারে তার ফেল করার কোনো সুযোগ নেই।
আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রার্থী মনিরুজ্জামানের পিতা মো. শাহাদাৎ হোসেন নলকুপ মেকানিক হিসেবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, শাল্লা উপজেলায় কর্মরত। অনেকের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, ব্যবহারিক পরীক্ষায় চাহিত গতি না থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে কপি-পেস্ট এর মাধ্যমে পাশ দেখানো হয়। অন্যদিকে কথিত আছে, গত নিয়োগগুলোতে বিভিন্ন জেলায় মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অগ্রাধিকার না দিয়ে সাধারণ কোটার প্রার্থীদের নিকট থেকে সুবিধা নিয়ে নিয়োগের অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন নিয়োগ কমিটি। আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির পদে বাছাই/নির্বাচন ও পদোন্নতি কমিটি দীর্ঘদিন এভাবেই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করে আসছেন নিয়োগ কমিটির সভাপতি শামছুল হক ভুইয়া ও সদস্য সচিব ফয়জুল ইসলাম সুমন। তাই দ্রুত চলমান ব্যবহারিক পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নিয়োগ কমিটি গঠনে প্রধান প্রকৌশলীকে সময় বেঁধে দিয়েছেন নেতারা। তা না হলে মন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলীপী ও অধিদফতরে আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয় আবেদনে।
এ বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম ভোরের পাতাকে বলেন, ‘অনেক অভিযোগের কথাই শুনেছি। একাধিক লিখিত অভিযোগও পেয়েছি। তবে, এ অভিযোগগুলো যাদের বিরুদ্ধে জবাবদিহিও তাদের। শিগগির এ কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে।’
আবেদনের বিষয়ে উল্লেখিত অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিয়োগ কমিটিরি সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শামছুল হক ভুইয়া মোঠোফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ব্যবহারিক পরীক্ষায় অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। পরীক্ষায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ছিল ওনারা কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিয়েছে এবং প্রত্যেকে আলাদা আলাদা নাম্বার দিয়েছে। এ পরীক্ষায় কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে, কারা কেনো এ অভিযোগ করেছে তা আমার জানা নেই।’