বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব কম মানুষই আছেন, যারা ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ শিখর ছেড়ে আদর্শ ও জনকল্যাণের প্রশ্নে সচেতনভাবে রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথে নেমেছেন। কিশোরগঞ্জের কৃতি সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করীম খান চুন্নু তেমনই এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব।
ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রেজাউল করীম খান চুন্নু ছিলেন বিচার বিভাগের একজন সফল ও সুপরিচিত কর্মকর্তা। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের (বিজেএসসি) তিনবারের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সততা, দক্ষতা ও প্রশাসনিক যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। এমন একটি সময়ে তিনি সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন, যখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতা প্রায় নিশ্চিত ছিল।
ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের সেই শীর্ষ মুহূর্তে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল উদাহরণ। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় থেকেই তিনি বিচারকের আসন ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রগঠনের আদর্শই তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি নির্মাণ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মাধ্যমে তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তিনি ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের প্রতিষ্ঠাকালীন ২৭ নম্বর সদস্য ছিলেন। সে সময় থেকেই সহপাঠী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করতেন, সুশৃঙ্খল রাজনীতিতে এগোতে পারলে তিনি নিজের সময়ের বহু রাজনীতিককে ছাড়িয়ে যাবেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পরের বছর বিসিএসের মাধ্যমে বিচার বিভাগে যোগ দিলেও রাজনীতির টান কখনোই তাঁর ভেতর থেকে হারিয়ে যায়নি। দীর্ঘ বিচারিক দায়িত্ব পালনের পর ২০০৬ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ থাকা অবস্থায় তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন এবং একই বছরের অক্টোবর মাসে বিএনপিতে যোগ দেন।
২০০৭ সালে বিএনপি তাঁকে ধানের শীষ প্রতীক দিয়ে মনোনয়ন দিলেও জরুরি অবস্থার কারণে সে সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তীতে সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরি ছাড়ার তিন বছরের মধ্যে নির্বাচন করতে না পারার আইনি জটিলতায় ২০০৯ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। ২০১৪ সালে বিএনপি ও জোট নির্বাচন বর্জন করায় সেবারও তিনি মনোনয়ন পাননি।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সবচেয়ে কঠিন সময়েও দল তাঁকে কিশোরগঞ্জ-১ (সদর-হোসেনপুর) আসনে মনোনয়ন দেয়। বহুল আলোচিত সেই নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ভোট গণনার প্রথম এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই তিনি ঢাকা বিভাগের সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আসেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যখন সাধারণ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের নিরাপত্তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল, তখন একজন মাঠপর্যায়ের প্রার্থীর পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
মনোনয়ন প্রসঙ্গে রেজাউল করীম খান চুন্নু বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মাত্র দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই তিনি লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হতে পারতেন। কিন্তু ভোটের আগের রাতে ভোট নেওয়ার ঘটনায় দলের নির্দেশে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
এদিকে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জ-১ আসনে তাঁকে মনোনয়ন না দেওয়ায় জেলা বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই সংবাদ সম্মেলন, মশাল মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচিসহ নানা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
চুন্নু অভিযোগ করে বলেন, জেলা বিএনপির সভাপতি মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচারের মাধ্যমে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে প্রভাব খাটিয়ে এমন একজনকে মনোনয়ন করিয়েছেন, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের ভোটাররা বিষয়টি মেনে নেয়নি বলেও তিনি দাবি করেন।
সাবেক সংসদ সদস্য মাসুদ হিলালী বলেন, বিচার বিভাগ থেকে রাজনীতিতে এসে রেজাউল করীম খান চুন্নুর এই দীর্ঘ পথচলা কেবল ব্যক্তিগত সংগ্রামের গল্প নয়; বরং আদর্শনিষ্ঠ ও ত্যাগী রাজনীতির এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়।