
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কর্মরত। একই সাথে স্বপ্রণোদিত দায়িত্বে তিনি যে নিজেকে নিরলসভাবে নিয়োজিত রেখেছেন মানবসেবায়। বিশেষ করে নিজ এলাকা নরসিংদীর বেলবোতে। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখা আর নতুন প্রজন্মের কাছে তা ছড়িয়ে দেয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টায় তিনি কাজ করে যাচ্ছেন অবিরত।
চারিদিকে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে সুবিধালোভী মানুষের প্রতিযোগিতা, তার ভিড়ে নিভৃতচারী খায়রুল বাকেরের নিজ এলাকায় আলোকবর্তিকা ছড়াচ্ছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা হিসাবে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে ১৭ টি সড়কের নামকরণ হয়েছে, এমন ঘটনা বিরল। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, সমাজসেবায় কি কি করেছেন কিংবা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কতগুলি লেখা বা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, সব জানা না হলেও আগরতলা মামলার ২৯ নং অভিযুক্ত এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট জলিলের ২০২২ সালে স্বাধীনতা পুরষ্কার প্রাপ্তিতে তার যে আন্তরিক কর্মতৎপরতা, সেই গল্প শুনে প্রকৌশলী খায়রুল বাকেরের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হওয়া যায় খুব সহজেই।
সার্জেন্ট জলিলকে নিয়ে লিখেছেন 'একটি গ্রেনেড, আগরতলা মামলা ও সার্জেন্ট জলিল', যা অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ এ প্রকাশিত, শুনেছি সমাদৃতও হয়েছে বেশ। বহু তথ্য, ছবি সমৃদ্ধ গ্রন্থটি নি:সন্দেহে গণ অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল।
গ্রন্থটি রচনার সময়ই বাকেরের অন্তর কেঁদে উঠেছিল - সেই আগরতলা মামলা থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের এত বছর অতিবাহিত হবার পরেও সার্জেন্ট জলিল কোন জাতীয় পুরষ্কারে ভূষিত হননি! তরিঘড়ি সার্জেন্ট জলিলকে স্বাধীনতা পুরষ্কার প্রদানের জন্য আবেদন করে বসলেন! কিন্তু অসম্পুর্ণ আবেদন প্রত্যাখাত হল। দমার পাত্র নন খায়রুল বাকের। ২০২২ এ আবার আবেদন করবেন যথাযথ ভাবে। সরকারের প্রতি নির্ধারিত ফরমে এই আবেদনে থাকতে হয় বিভিন্ন দলিলের সংযুক্তি, স্বাধীনতা পুরষ্কারপ্রাপ্ত বা বরেণ্য কোন ব্যক্তির সুপারিশ ইত্যাদি। স্বাধীনতা পুরষ্কারপ্রাপ্ত কয়েকজনের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন, ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ফিরতে হয়েছে, সুপারিশ পাননি! অবশেষে সম্মতি জানালেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও পরিবেশকর্মী ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ।
সময় দিলেন বেলা আড়াইটায়, যেদিন বিকেল ৫টায় আবেদনের শেষ সময়। যথাসময়ে স্বাক্ষর নিয়ে ঝড়ের বেগে ফিরলেন অফিসে। এক একখানা আবেদনে ৪ কপি ছবি, ২৭ খানা সংযুক্তি - এমন ৩৮ টি আবেদনের সেট বানাতে হবে। কয়েকজন সহকারীর সাহায্যে সব সেট রেডি করতে বেজে গেল ৪.৪৫। হাতে আছে ১৫ মিনিট সময়, জমা দিতে হবে সচিবালয়ে, বেশি দূরে নয়, গাড়ি নিয়ে ছুটলেন। গেটে আটকে দেয়া হল, পাশ নেই! কয়েক মিনিট মাত্র আছে। ভিতরে পরিচিত জনকে ফোন করলেন, তিনি বললেন অন্য আরেকটি গেট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে। ৩৮ সেট আবেদনের বান্ডিল মাথায় নিয়ে দৌড় দিলেন সেই গেটে, জানলেন গেট বন্ধ হয়ে গেছে। আবার দৌড়ে ফিরে এলেন প্রথম গেটে। সেই পরিচিত জনকে এবার ফোন করে অনুরোধ জানালেন স্বয়ং এসে সেই বান্ডিল নিয়ে গিয়ে জমা দিতে। তিনি এসে খায়রুল বাকেরকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। আবেদন জমা দেয়া হল, তখন ঘড়িতে ৪.৫৮।
এই আবেদনেই সার্জেন্ট জলিল পেলেন ২০২২ এর স্বাধীনতা পুরষ্কার। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চ থেকে নেমে এসে সামনে বসে থাকা অশীতিপর বীরের হাতে তুলে দিলেন সেই সম্মাননা।
ছোট্টবেলা থেকেই প্রখর মেধাবী খায়রুল বাকের ১৯৮৪ সালে ৮ম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় নরসিংদী মহকুমার মধ্যে ১ম হয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। এছাড়া কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেই বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেয়েও মন মতো বিষয় না পেয়ে চুয়েটে পড়াশোনা করেন। তখনকার সময়ে ক্লাস নাইনের ভাল ছাত্ররা স্কুলের যেকোন প্রোগ্রামের নেতৃত্ব দিতেন, সে সময়ে ক্লাসের ফার্স্ট বয় হিসাবে ছাত্ররাজনীতির সকল প্রোগ্রামের নেতৃত্ব দিতেন এই খায়রুল বাকের। ১৯৮৯ হতে ১৯৯৫ পর্যন্ত চুয়েটে তিনি শহীদ তারেক হুদা হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং চুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। তখন ছাত্রশিবির ও এনডিপির বহু নির্যাতনের শিকার তিনি হয়েছিলেন। তার শরীরে সেসবের চিহ্ন এখনো আছে। চুয়েটে থার্ড ইয়ার পর্যন্ত প্লেসধারী ছাত্র হলেও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠতার কারণে পরীক্ষার পূর্বে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় তার প্লেস ছুটে যায়। তারপরও সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে ১ম বিভাগ পেয়ে পাস করেন এবং পরে উচ্চশিক্ষার স্কলারশীপ পেয়েও চাকরি করা জরুরি প্রয়োজন থাকায় বিদেশে পড়তে যাননি। প্রকৌশলী খায়রুল বাকের দক্ষতা ও সুনামের সাথে ঢাকাস্থ বেলাব সমিতির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
২০২০ সালে নরসিংদীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন এবং এলাকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে রাস্তার নামকরণ বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন; মুক্তিযুদ্ধের হারানো গৌরব সকলের সামনে তুলে ধরছেন। এছাড়া এলাকায় শিক্ষা প্রসারের কাজে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
এমনকি নিজ এলাকার নরসিংদী বেলবোতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলিত কবর সংরক্ষণ ও পাকাকরণের ব্যবস্থাও করেছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু লায়েছ ও আবদুস সালামের কবর। এছাড়া যেসব শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকদের নামে বিভিন্ন রাস্তার নামকরণ করেছেন খায়রুল বাকের সেগুলো হচ্ছে- ) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিক নূরু সড়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহন সড়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট(অবঃ) জলিল সড়ক, বীর ৪) মুক্তিযোদ্ধা ও বরেণ্য রাজনৈতিক বাবর আলী সড়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক সার্জেন্ট কাদির সড়ক, সংগঠক সামসুল ইসলাম ( সুরুজ ফকির) সড়ক, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক, সংগ্রামী কৃষক নেতা ও বরেণ্য শিক্ষাবিদ ফজলুল হক খোন্দকার সড়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক কমরেড আবদুল হাই সড়ক, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক, কৃষক নেতা ও সাবেক ইউ পি চেয়ারম্যান সামসুল হক ভূঞা ( মাহতাব) সড়ক। এছাড়া প্রস্তাবিত আছে আরো ৮ টি সড়কের নামকরণ।
এসব বিষয়ে খায়রুল বাকেরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার শিক্ষাগুরু আবদুল হামিদ এমএস সি সাহেবও এলাকায় কাজ করতে এসে বিভিন্ন বাঁধা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। আমার বেলায়ও হবে, এ কথা জেনে বুঝেই কাজ করে যাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও করবো।