
গ্যাসের নগরী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্যাস তেল অনুসন্ধান কাজের জন্য ভূমি হুকুম দখল ও অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে খুদ তিতাসের আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক (এস্টেট) কাজী মাইনুল হোসাইন গড়ে তুলেছেন অসাধু সিন্ডিকেট। বিভিন্ন কৌশলে এই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ ও সরকারের কোটি কোটি টাকা। সেই সিন্ডিকেটকে অবৈধ সুবিধা দিতে তিতাস-৩১ কূপ এর ভূমি হুকুমদখল কার্যক্রমে নিয়ম না মানার অভিযোগ ওঠেছে জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, তিতাসে চাকরির সুবাধে কাজী মাইনুল আগে থেকেই জানতে পারেন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কোন এলাকায় হুকুম দখল শুরু হবে। তিনি সেসব এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাথে নিয়ে জমির মালিকদের থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে সেখানে দৃশ্যমান স্থাপনা তৈরি করে রাখেন। তারপর হুকুম দখলের জন্য জরিপের সময় সেসব স্থাপনার কয়েকগুণ বেশি ক্ষয়ক্ষতি দেখিয়ে যোগসাজসের মাধ্যমে সরকারের টাকা আত্মসাত করে নেন। তার কাছে আগাম জমি ভাড়া দিতে না চাইলে জরিপের সময় তিনি জমির মালিকদের ক্ষয়ক্ষতি কম দেখিয়ে তাদের বঞ্চিত করেন। এছাড়া ক্ষতিপূরণ বেশি পাইয়ে দেয়ার নামে তাদের কাছে ৪-৮ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন বলেও অভিযোগ করেছেন ভূক্তভোগীরা। এই কাজে পরোক্ষভাবে কাজী মাইনুলকে সহযোগিতা করেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নে বিজিএফসিএল এর তিতাস ফিল্ডে গভীর গ্যাস কূপ (Deep well) তিতাস-৩১ এর খনন এলাকা ও সংযোগ সড়কের জন্য ভূমি হুকুম দখল কার্যক্রম পরিচালনা করছে জেলা প্রশাসন। ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন অনুযায়ী অধিগ্রহণ ও হুকুম দখলের জন্য কোন প্রকল্প নির্বাচন করলে সরকারের অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথে প্রকল্প এলাকায় দৃশ্যমান বিজ্ঞপ্তি টানাতে বলা হয়েছে। কিন্তু তিতাস-৩১ কূপ প্রকল্পের জন্য হুকুম দখল কার্যক্রম ২৫ মার্চ ২০২৪ তারিখ থেকে শুরু হলেও কোনো জমি মালিকদের অবগতকরণের জন্য প্রকাশ্যে কোনো বিজ্ঞপ্তি টানানো হয়নি। হুকুম দখলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যক্রম শুরুর পর জনসম্মুখে প্রদর্শনের জন্য বিজ্ঞপ্তি না লাগিয়ে প্রায় ৮ মাস সময় দেওয়া হয় তিতাস কর্মকর্তা মাইনুল সিন্ডিকেটকে। এই সময়ের মধ্যে মাইনুল তার বলয়ের লোকদের দিয়ে ক্ষতিপূরণের নামে সরকারি টাকা আত্মসাত করার লক্ষ্যে স্থানীয়দের হুকুম দখলের বিষয়ে অন্ধকারে রেখে তাদের থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে নামমাত্র স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন। পরবর্তীতে ৪ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ জরিপ পরিচালনার জন্য আচমকা জামি মালিকদের চিঠি দেয়া হলে তারা বিষয়টি জানতে পারেন।
জেলা প্রশাসনের ভুমি অধিগ্রহণ শাখা সূত্রে জানা যায়, বিজিএফসিএল এর তিতাস ফিল্ডে "গভীর গ্যাস কূপ (Deep well) তিতাস-৩১ এর খনন প্রকল্পের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নন্দনপুরে মোট ৬.৪৫১৬ একর জায়গা হুকুমদখল নেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে নন্দনপুর মৌজায় ০.৯৮৬৬ একর এবং সুতিয়ারা মৌজার ৫.৪৬৫০ একর জমি রয়েছে। হুকুম দখলকৃত ভূমির অবকাঠামো, গাছপালা, ব্যবসায়িক ও ফসলের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৬২ টি পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৬ কোটি ৬৮ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এখন পর্যন্ত ২১ জনকে ৩ কোটি ১৬ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর করা হয়েছে।
অভিযোগ আছে, নন্দনপুর মৌজায় হস্তান্তরকৃত এই টাকার প্রায় ৭০% পেয়েছেন তিতাসের আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক (এস্টেট) কাজী মাইনুল সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ভুমির মালিকদের অন্ধকারে রেখে সরকারের এই টাকা আত্মসাত করেছে চক্রটি।
সরেজমিনে জানা যায়, তিতাস কর্মকর্তা কাজী মাইনুলের হয়ে প্রকল্প এলাকায় নন্দনপুর মৌজায় ৬৩৮ নং দাগের মালিক আব্দুল লতিফ থেকে জায়গা ভাড়া নেন পার্শ্ববর্তী এলাকা আব্দুল মালেকের ছেলে জামাল মিয়া। তড়িঘড়ি করে একটি মুরগীর ফার্ম স্থাপন করে ২২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করেন।
একই কায়দায় ৩০৯ দাগের মালিক সিরাজুল ইসলামের থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে কারখানা শেড তৈরি করে মোশারফ মিয়া ৮৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ উত্তোলণ করেন। জেলাপ্রশাসনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনের জরিপের সময় তিনি ভাড়া করা জয়গায় প্রকাশ্যে সাইনবোর্ডে লিখে রাখেন ‘ভাড়াটিয়া সূত্রে জায়গার মালিক’ হিসেবে নিজের নাম। জেলা প্রশাসনের জরিপে উঠে আসেনি এসব অনিয়মের কথা।
আইন অনুযায়ী এই ধরণের পরিকল্পিত অবৈধ স্থাপনা বা ভূমির ক্যাটাগরি পরিবর্তনের কাজগুলোকে জেলা প্রশাসককে লিপিবদ্ধ করার কথা থাকলেও নিয়মের তোয়াক্কা না করে সরকারের অর্থ লোটে নিয়েছে চক্রটি। অভিযোগ আছে যার সিংহভাগ অর্থ ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা ও জরিপকাজে সংযুক্ত কর্মকর্তাতের যোগসাজসে আত্মসাত করেছে কাজী মাইনুল চক্র। মাইনুলের কথামত তার চক্রের কাছে আগাম জমি ভাড়া না দিলে কিংবা হুকুমদখলে সঠিক ক্ষতিপূরণ পেতে তাকে ঘুষ না দিলে বঞ্চিত করা হয়েছে জমি মালিকদের।
মাইনুলের এই অপকর্মের প্রধান সহযোগী বুধল ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ন আহবায়ক হারিজ মিয়া। মূলত পতিত সরকারের আমলে হারিজের মাধ্যমে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে ঘুষ বাণিজ্য চালান তিনি। এই প্রতিবেদকের কাছে আসা কাজী মাইনুলের একাধিক অডিও ও ভিডিও রয়েছে। একটি অডিও বিশ্লেষণ করে শোনা যায় কাজী মাইনুল হুকুম দখলে জমির ক্ষতিপূরণ বেশি পাইয়ে দেয়ার জন্য ৪ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করছেন। এবং সেটি সময়মত না দেয়ার কারণ পরিবারটিকে হুমকি দিচ্ছেন। ‘তাকে টাকা না দিলে ক্ষতিপূরণ পাবে না’ এমন ভয় দেখিয়ে অন্য একজনের কাছে ৭ লক্ষ টাকা ঘুষ দাবি করেছেন মাইনুল তারও প্রমাণ প্রতিবেকদের হাতে এসেছে। পরিবারটি নিরূপায় হয়ে কাজী মাইনুলের স্ত্রীর সোনালী ব্যাংক ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার একটি একাউন্ট ৭০ হাজার টাকা ঘুষ দেয়। এভাবে এই এলাকার ১২ জন জমির মালিক থেকে পর্যায়ক্রমে প্রায় ১৬ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন মাইনুল। অনেকের থেকে আগাম ব্যাংক চেক নিয়ে রেখেছিলেন তিনি। ঘুষের এসব টাকা লেনদেনে তার স্ত্রীর একাধিক একাউন্ট ব্যবহার করেছেন। তার এই দুর্নীতির জাল বিছাতে পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার ২ কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড লিমিটেড ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালকও।
স্থানীয় জমির মালিক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘মাইনুলকে পেছন থেকে সহযোগিতা করছে প্রশাসনের বড় কর্মকর্তারা। সে আমার থেকে অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাদের নাম করে ঘুষ চেয়েছে তার প্রমাণ আছে। আমি ঘুষের টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় জরিপে আমার জমিকে ভুল বর্ণনা দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কম দেখাইছে। টাকা আত্মসাত করতে বিধ্যমান রাস্তা থাকা পরও প্রজেক্টের মূল সড়কের সাথে সমন্বয় না করে তার পাশেই আলাদা সড়ক করেছে সে যাতে তাকে যারা খুশি করেছেন তাদের বেশি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া যায় একই সাথে দুই রাস্তার মাঝখানে আমাদের জমি ফেলে তার ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দেখানো সম্ভব হয়।’
স্থানীয় আরেক জমির মালিক আলী আহম্মেদ বলেন, ‘আমাদের ঘরবাড়ি-ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছি তাতেও আমরা সঠিক ক্ষতিপূরণ পাচ্ছি না। আর মাইনুলরা অবৈধ স্থাপনা করে কয়েকগুণ টাকা তুলে নিচ্ছে তার লোকজনকে দিয়ে। ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে আমার থেকে ৩ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছিল সে। এছাড়া আমার জমি ভাড়া নিতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে আমার প্রতি অন্যায় করেছে।’
এ বিষয়ে কাজী মাইনুল হোসাইনের সাথে যোগাযোগ করে অভিযোগের ব্যাপারে তার বক্তব্য চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড এর এমডির কাছে যেতে বলেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে ব্যবস্তার কথা বলে কল কেটে দেন বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড লিমিটেড ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার ফারুক হোসেন। পরবর্তীতে তাকে ফোন করে পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে হুকুম দখলের ক্ষেত্রে জাতীয় অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে কেবলমাত্র পরিবহণ যোগাযোগের জন্য রাস্তা নির্মাণ ব্যতিত অন্য কোনো কাজে একমাত্র বসতভিটে হুকুমদখল নেয়ার বিধান না থাকলেও সুতিয়ারা এই প্রকল্পে তা মানা হচ্ছে না। সুতিয়ারা মৌজায় প্রায় ১৫টি পরিবারকে ভিটে ছাড়া করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রশাসন। ভিটে ছাড়তে হলে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় হুকুমদখলকে প্রত্যাখ্যান করেছেন সেখানকার মোট ৪১টি পরিবার। সম্প্রতি কাজী মাইনুলে দুর্নীতির প্রতিবাদ ও ভূমির ন্যায্য হিস্যা বুঝে পেতে মানববন্ধন করেছেন সুতিয়ারা গ্রামের ভূক্তভোগীরা। মানববন্ধনে ক্ষতিগ্রস্থ ভূমি মালিকরা জানান, তিতাসের উপব্যবস্থাপক (এস্টেট) কাজী মাইনুল হোসেনের নেতৃত্বে একটি চক্র অধিগ্রহনকৃত ভূমির বেশি ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেবার আশ্বাস দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মাইনুলের দাবি অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় প্রকৃত মালিকদের অনেকে ক্ষতিপূরণ পাননি। তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উচ্ছেদের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. দিদারুল আলম বলেন, হুকুমদখলের কাজ এখনো চলমান এবং এটি সম্পূর্ণ জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। এই কাজে তিতাসের উপব্যবস্থাপকের যুক্ত থাকার সুযোগ নেই। যদি কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের নাম ব্যবহার করে দুর্নীতি করে তাহলে এর দায় আমাদের নয়। তবে জেলা প্রশানের অধিগ্রহণ শাখার কেউ যদি এর সাথে জড়িত থাকে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
জানা যায়, বাপেক্সের প্রাথমিক অনুসন্ধানে যেসব এলাকায় গ্যাসের সম্ভাবনা থাকে সেখানে বিস্তর অনুসন্ধান ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড লিমিটেডকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সেসব জায়গায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে ভূমি মালিকদের থেকে হুকুম দখল নেয়া হয়। ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন অনুযায়ী জাতীয় স্বার্থে হুকুম দখলকৃত জমির মালিকদের বিভিন্ন পর্যায়ে জমির উপর নির্মিত স্থাপনা, ফসল ও আর্থিক ক্ষতি হবে এমন কিছু বিনষ্ট হওয়ার থাকলে তার দেড় শতাংশ ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়।
তিন পর্বের ধারাবাহিক তিতাসের মাইনুলনামার ২য় পর্ব ‘ এক মাইনুলের ৫টি সিন্ডিকেট, অবৈধ আয়ে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়’ পড়তে চোখ রাখুন।