
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি শুধু দুজন নেতার জন্যই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির জন্যও ছিল এক মোড় ঘোরানো ঘটনা। বৈঠকের আগে পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ ও অনিশ্চিত। কোনো প্রাক-সমঝোতা ছিল না। বিএনপি ছিল অনড়—তাদের দাবি ছিল এই বছর ডিসেম্বরেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যদিকে ড. ইউনূস নির্বাচনের সময়সূচি আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবে অনড় ছিলেন। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল তারেক রহমানের ভাবমূর্তি, যোগ্যতা এবং শাসনব্যবস্থার প্রতি তার উদ্দেশ্য নিয়ে ড. ইউনূসের গভীর সংশয়।
তবে, একবার যখন দুই পক্ষের সহকারীরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, তখন দুই নেতা একান্তে প্রায় এক ঘন্টা বিশ মিনিট ধরে মন খুলে কথা বলেন — এবং কিছু অসাধারণ ঘটতে শুরু করে। শুরুতে কথোপকথনটি একটু সংযত ও দ্বিধান্বিত ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা রূপ নেয় গভীর, সৎ ও আন্তরিক এক আলোচনায়। আলোচনার পর ড. ইউনূসের চোখে তারেক রহমানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি পাল্টে যায়। তিনি তারেক রহমানকে দেখেন একজন বাস্তববাদী ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন নেতা হিসেবে, যার একটি পরিষ্কার ও সুসংগঠিত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে শাসনব্যবস্থা, সংস্কার এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তিনি বোঝেন, তারেক একজন চিন্তাশীল সংস্কারপন্থী, যিনি একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক বাংলাদেশের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তাদের আলোচনা বিস্তৃত ছিল—নির্বাচন সংস্কার, গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন ছিল প্রধান বিষয়বস্তু। যদিও কিছু বিষয়ে মতবিরোধ ছিল, তবু তারেক রহমান ছিলেন নম্র ও সহনশীল।
এই বৈঠকের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফলের একটি হলো নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে একটি সম্মতিতে পৌঁছানো। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ হলো রমজানের আগেই — যা কেবল বিএনপির দাবিই নয়, বরং জামায়াতে ইসলামিসহ আরও কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দলের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। এটি তারেক রহমানের মধ্যপন্থী অবস্থান এবং রক্তপাত এড়িয়ে চলার সদিচ্ছার প্রতিফলন।
তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি ঘটেছিল ড. ইউনূসের নিজের ভিতরে। তিনি প্রথমবারের মতো তারেক রহমানকে চিনতে পারেন — একজন সুদক্ষ বক্তা, বিবেকবান, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও সম্মান প্রদর্শনকারী মানুষ হিসেবে। তার এই ব্যক্তিত্ব গত দুই দশক ধরে প্রচারিত নেতিবাচক সংবাদমাধ্যমীয় চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশেষ করে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার দীর্ঘদিন ধরে তারেক রহমানকে নিয়ে একতরফাভাবে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে গেছে। এই পত্রিকাগুলোকে প্রায়ই বিদেশি দূতাবাস ও স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবাধীন বলে অভিযুক্ত করা হয়ে থাকে। তারা বহু কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যা জনমতকে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করেছে। এ ধরনের সাংবাদিকতা সাংবাদিকতার ন্যূনতম নৈতিকতা থেকেও বিচ্যুত ছিল।
একজন আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তির — যেমন ড. ইউনূস — দৃষ্টিভঙ্গির এই রকম আমূল পরিবর্তন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি যেমন তারেক রহমানের জাতীয় নেতৃত্বের সম্ভাবনাকে জোরালো করে তোলে, তেমনি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব ও ভূমিকা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তোলে। যখন শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলো সত্য প্রকাশের বদলে অপপ্রচারের হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন তার ফল শুধু ব্যক্তিগত মানহানি নয় — জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধেও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। আমরা গত ১৬ বছর ধরে এই একতরফা অপপ্রচারের মূল্য স্বৈরশাসনের মাধ্যমে দিয়ে যাচ্ছি।
(লেখাটি অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খানের ফেসুবক প্রোফাইল থেকে নেওয়া)