
গণঅভ্যুত্থানে তখন উত্তাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার আজমত আলী ছিলেন সেখানে। গত ৪ আগস্ট কথা হয় একমাত্র মেয়ে নাদিয়া আক্তারের সঙ্গে। এরপর থেকে আর তাকে পাওয়া যায়নি। পরদিন জানতে পারেন আজমত আলী গুলিতে নিহত হয়েছেন।
প্রায় সাত মাস পেরিয়ে গেলেও যেন চোখের পানি ফুরায়নি নাদিয়ার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বোরকা লাগত নায়, বাবা তুমি ফিরে আও, তোমারে আর কোনো দিন বোরকার কথা কইতাম নায়, তুমি আইলেই অইব।’
নাদিয়া আক্তার নবীগঞ্জ ম্যাপল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ৪ আগস্ট বাবার সঙ্গে কথা বলে নতুন বোরকা কিনে দেওয়ার আবদার করে।
ওই সময় তার বাবা ফোনে জানিয়েছিলেন, ঢাকায় এখন আন্দোলন চলছে, সবকিছু বন্ধ। তিনি বাড়িতে আসবেন, নয়তো দোকান খুললেই এক সপ্তাহের মধ্যেই বিকাশে বোরকার টাকা পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু পরদিনই তাঁর মৃত্যুর খবর আসে।
আজমত আলী নবীগঞ্জ পৌর এলাকার হরিপুর গ্রামের মজর আলীর ছেলে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। গত ১৫ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এটি প্রকাশ করেছে। সরকারি এই গেজেট অনুযায়ী ওই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যা ৮৩৪। এর মধ্যে আজমত আলী রয়েছেন ৪৭৬ নম্বরে।
আজমত আলীর পরিবারে রয়েছেন তার দুই ছেলে মাহফুজ আলম মাহিদ (১৮), মাহিনুর আলম মাহিন (১২) ও এক মেয়ে নাদিয়া আক্তার (১৫) এবং স্ত্রী রবিরুন বেগম।
স্থানীয়রা জানান, অভাব-অনটনের মাঝে ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টে জীবন যাপন করছেন আজমত আলীর স্ত্রী রবিরুন বেগম। তারা এখনো জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সহায়তা পাননি। পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এলাকাবাসী।
রবিরুন বেগম জানান, তার স্বামী ঘটনার আগের দিন (৪ আগস্ট) রাতে শেষবারের মতো ফোনে কথা বলেন। প্রথমে তার মেয়ে নাদিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। নাদিয়া তার বাবার কাছে একটি বোরকার কথা বলে। কিন্তু ৫ আগস্ট লাশ হয়ে যান। অবুঝ মেয়েটি প্রতিনিয়তই বাবার কবরে পাশে গিয়ে কান্নাকাটি করে বলে, বাবা তুমি ফিরে এসো, আমার বোরকা লাগবে না। আমি কখনো তোমাকে বোরকার জন্য বলব না বাবা।
রবিরুন বেগম বলেন, ‘অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এ কারণে ঢাকায় যান। পাঁচ বছর ধরে ঢাকায় মাছের ব্যবসা করেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেল। টিভিতে ও খবরের কাগজে দেখেছি, বিভিন্ন জায়গায় শহীদ পরিবারকে সরকারিভাবে সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা এখনো কিছু পাইনি।’
নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মো. রুহুল আমিন বলেন, সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে শহীদ আমজত আলীর নাম। সরকারি সহায়তার বিষয়টা প্রক্রিয়াধীন আছে। ইতিমধ্যে আমরা আমজত আলীর স্ত্রীর নামে সোনালি ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট করিয়েছি এবং অ্যাকাউন্টের তথ্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠিয়েছি। আশা করছি খুব শিগগিরই সরকারি অনুদান পাবেন।
ইউএনও রুহুল আমিন আরও বলেন, গত ৩ মার্চ তাদের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের খোঁজ নিয়েছি। রমজানে ইফতারসামগ্রী কেনার জন্য পৌরসভার ফান্ড থেকে ছোট একটা অনুদান দিয়েছি। তার মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করা হবে।