
ঢাল নেই তলোয়ার নেই, যেন নিধিরাম সর্দার। নেই কোনো বিদেশ পাঠানোর সরকারি নিবন্ধন কিংবা কোনো দেশে জনবল পাঠানোর ছাড়পত্র, তারপরও ফেসবুক ও অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ‘রেইওয়া আইটি এন্ড কনসালটেন্সি’ নামের প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মাসুদ রানা।
জাপানে দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকার মতো লোভনীয় উচ্চ বেতনের চাকরি ও ভিসা করিয়ে দেয়ার মিথ্যে প্রলোভন দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তার নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র কাজ করছে বলেও জানা যায়। তারা জাপানে চাকরির ভিসা পাইয়ে দেওয়ার নাম করে প্রার্থীদের কাছে ভুয়া তথ্য সরবরাহ করে থাকে এবং মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত অনেক মানুষকে নিঃস্ব করার অভিযোগ ইদানিং কয়েকটি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বিভিন্ন বাজে মন্তব্য করতেও দেখা যাচ্ছে।
তাদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা দাবি করেন, তাদেরকে জাপানে আড়াই লক্ষ টাকা বেতনে চাকরির আশ্বাস দিলে ধাপে ধাপে মাসুদ রানা বা তার প্রতিষ্ঠানকে বিপুল অর্থ পরিশোধ করেন কিন্তু দীর্ঘদিন কালক্ষেপণ করেও ভিসা দিতে ব্যর্থ হলে, ভুক্তভোগীরা অর্থ ফেরতের দাবি জানালে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয় এবং সেনাবাহিনীর অফিসার পরিচয় দিয়ে ভয় দেখানো হয়। এমনকি হুমকি দিতে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ঘনিষ্ঠজন ও সাবেক সেনাসদস্যদের নাম ব্যবহার করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।
ভোরের পাতার অনুসন্ধানে জানা যায়, এই মাসুদ রানার বড় ভাই সার্জেন্ট (অব.) মনোয়ার যিনি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ড্রাইভার হিসেবে ছিলেন। সেই পরিচয়েই মিরপুরসহ আশেপাশের এলাকায় তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বলয়। হঠাৎ করেই বিপুল অর্থ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন বলেও জানা যায়।
সরেজমিন তদন্তে দেখা গেছে, মাসুদ রানা ও তার চক্র শুধু জাপানে চাকরির নামে নয়, বরং জমি কেনাবেচার প্রতারণার সঙ্গেও জড়িত। বিভিন্ন বিতর্কিত সম্পত্তি কম দামে কিনে, তা উচ্চমূল্যে বিক্রির নামে সাধারণ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
এই প্রতারণার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘রেইওয়া আইটি অ্যান্ড কনসালটেন্সি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যার মূল হোতা মাসুদ রানা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বেকার যুবকদের আকৃষ্ট করে প্রতিষ্ঠানটি। চাকরির সুযোগের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি জাপানি ভাষা শেখানোর নামে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ফি নেয়। তবে এদের বিদেশে লোক পাঠানোর কোনো সরকারি অনুমোদন নেই। এমনকি বায়রা (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ)-এর বৈধ সদস্যপদও নেই।
ভোরের পাতার অনুসন্ধানে যা যা উঠে এসেছে
প্রতারণার কৌশল ও চক্রের কাজের ধরন: এই চক্র প্রতারণার জন্য অভিনব কৌশল গ্রহণ করেছে। ভুক্তভোগীদের আস্থা অর্জনের জন্য তারা প্রথমে একটি সেমিনার বা প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করে। সেখানে চাকরিপ্রত্যাশীদের বলা হয়, জাপানে চাকরি পেতে হলে তাদের অবশ্যই জাপানি ভাষায় দক্ষ হতে হবে। এরপর শুরু হয় প্রতারণার মূল প্রক্রিয়া।
ভাষা শেখানোর নামে অর্থ আদায়: চাকরিপ্রার্থীদের ভাষা প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি ফি ও কোর্স ফি বাবদ মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হয়।
জাপানি কোম্পানির সঙ্গে ভুয়া ইন্টারভিউ: একটি ল্যাপটপ স্ক্রিনে প্রার্থীদের দেখানো হয়, তাদের ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে। তবে বাস্তবে এসব ইন্টারভিউ কোনো জাপানি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। জাপানে চাকরি প্রত্যাশীদেরকে প্রলুব্ধ করতেই তিনি এ ধরনের ছলনার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। তার প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমোদন ও ছাড়পত্র নেই তারপরও তিনি বা তার প্রতিষ্ঠান জাপানের এতগুলো প্রতিষ্ঠানে কোন শর্তে এবং কোন আইনে লোক পাঠায় তার সদুত্তর তিনি আমাদেরকে দিতে পারেননি।
ভিসা প্রসেসিং ফি ও প্রতিশ্রুতি: ইন্টারভিউ শেষ হলে বলা হয়, তারা নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর ভিসা প্রসেসিং ও অন্য আনুষঙ্গিক খরচের নামে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা নেওয়া হয় বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। জাপানে বাংলাদেশিদের জন্য সর্বনিম্ন দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকার চাকরি আছে এবং সেই শুধু বাংলাদেশের জনবল নিয়োগ দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত বলেই সবাইকে বোঝানো হয়।
কালক্ষেপণ ও নতুন প্রতিশ্রুতি: টাকা নেওয়ার পর দীর্ঘদিন কালক্ষেপণ করা হয়। প্রার্থীরা যখন তাদের ভিসার বিষয়ে জানতে চান, তখন আরও ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়। টাকা একবার টাকা নিলে বছরের পর বছর কালক্ষেপণ করা এবং অর্থ আত্মসাৎ করাসহ অর্থ ফেরত না দেয়া ও চুপ থাকার জন্য ভয়ভীতি ও হুমকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
হুমকি ও ভয়ভীতি: কেউ টাকা ফেরতের দাবি করলে, তাদের বিভিন্নভাবে ভয় দেখানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে সাবেক সেনা সদস্যদের নাম ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয় বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।
মাসুদ রানার পরিচয় ও সামরিক সংযোগ: তদন্তে জানা গেছে, প্রতারক মাসুদ রানা নিজেকে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচয় দিলেও তার প্রকৃত পেশাগত যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ড্রাইভার ও সাবেক সেনাসদস্য সার্জেন্ট মনোয়ারের ছোট ভাই। এই পরিচয়ের কারণে তিনি দীর্ঘদিন ধরে সামরিক বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যকে ব্যবহার করে প্রতারণা চালিয়ে আসছেন।
ব্যাংকিং জালিয়াতি ও অর্থ পাচার: তদন্তে জানা গেছে, মাসুদ রানার পরিবার অসংখ্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে। এসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিদেশ গমনেচ্ছুকদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ লেনদেন করা হয়। চক্রটি ভুয়া ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট তৈরি করে, যা বিভিন্ন দেশের ভিসা আবেদনকারীদের জালিয়াতির জন্য ব্যবহার করা হয়। তিনি বিদেশে লোক পাঠানোর নামে দেশের বিভিন্ন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অর্থ পাচার করছেন কিনা সেটা খতিয়ে দেখা বা বিস্তর তদন্তের প্রয়োজন বলেও অনেকে দাবি করেছেন।
ফেসবুকে প্রতারণার তথ্য প্রকাশ, মামলা ও হয়রানি: ভুক্তভোগীদের অনেকে প্রতারণার বিষয়টি ফেসবুক গ্রুপ ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেন। তবে মাসুদ রানার চক্র তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নাম পরিচয় ব্যবহার করে তাদের হয়রানি করে। অভিযোগ রয়েছে, তারা কিছু সাংবাদিক ও প্রভাবশালীদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করারও চেষ্টা চালিয়েছে।
ভুক্তভোগীদের আর্তনাদ ও প্রশাসনের নীরবতা: প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীদের দাবি, মাসুদ রানা ও তার চক্রের বিরুদ্ধে গভীর তদন্ত পরিচালনা করা হলে সাবেক সেনাপ্রধানের গোপন সম্পদ এবং অপরাধের আরও বহু তথ্য বেরিয়ে আসবে। শুধু জাপানের চাকরির নামে প্রতারণাই নয়, চক্রটি জমি কেনাবেচা, ব্যাংক জালিয়াতি ও অর্থ পাচারেও জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন: এত বড় প্রতারণা চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ভুক্তভোগীরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন, রেইওয়া আইটি অ্যান্ড কনসালটেন্সির বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত চালানো হোক এবং প্রতারক মাসুদ রানা ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা হোক। এছাড়াও ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিদেশে চাকরির নামে প্রতারণা বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হোক।