বিজয়ের মাস বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মহত্তম ও গৌরবময় ঘটনা অর্জন হয় আমাদের এই বিজয় মাসে। নিশ্চয় একটা দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে আমরা একটি ভিন্ন সময় উপভোগ করছি। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্য দিয়ে এবারের উদযাপনের বাহ্যিক রূপটা একটু ম্লান হয়েছে। এবারের আয়োজনকে অনেক সীমিত আকারে করতে হচ্ছে আমাদেরকে। এটি নিশ্চয় আমাদের জাতির জন্য একটি গৌরবের বিষয়।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৫৪৫তম পর্বে সোমবার (৬ ডিসেম্বর) এসব কথা বলেন আলোচকরা। ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- সেক্টর কমান্ডার ফোরামের যুগ্ম মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মাবুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া কাঞ্চন, গৌরব ৭১ এর সাধারণ সম্পাদক, জাগরণ টিভির প্রধান সম্পাদক এফ এম শাহীন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভোরের পাতার বিশেষ প্রতিনিধি উৎপল দাস।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মাবুদ বলেন, বিজয় মাস বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মহত্তম ও গৌরবময় ঘটনা আমাদের এই বিজয় মাসে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন করুণ, শোকাবহ, লোমহর্ষক, তেমনি ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ও বীরত্বপূর্ণ। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতি অর্জন করেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের এই বিজয় অর্জিত হয়। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ অর্জনের ও আত্মগৌরবের একটি দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি বিজয় ছিনিয়ে আনে। বাঙালি জাতির ইতিহাস হাজার বছরের পরাধীনতার ইতিহাস। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হলেও এই ভূখণ্ডে বাঙালির স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আসেনি। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয় এবং পূর্ব বাংলাকে নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি অসম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালির ওপর চেপে বসে এবং শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতি ১৯৭১ সালে উপনীত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’... যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’ খ্যাত কালজয়ী ভাষণ ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে চূড়ান্তভাবে উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন প্রভূত ঘটনা প্রবাহের মধ্য স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। তাই এই মাস আমাদের গর্বের মাস। মুক্তিযুদ্ধ না হলে আমরা স্বাধীন হতে পারতাম না। অনেক কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে যারা আমাদের মতো এত ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে। শুধু এই মাস নয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কথা স্মরণ করে দেয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় সহযোগী ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জয় হয়েছিল। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের পর সেদিন মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিল। যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন-স্বজনদের জন্যে কেঁদেছিল চিৎকার করে। যে চেতনা ও উদ্দেশ্য নিয়ে একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আপামর জনসাধারণ, তার বাস্তবায়ন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা নিয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তথা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলছে তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া কাঞ্চন বলেন, আজকে এমন একটা সময়ে আমরা আলোচনা করছি এটা হলো এই মাসটি আমাদের জন্য আনন্দের মাস, এই মাসটি আমাদের বিজয়ের মাস। তাই এই বিজয়ের মাসে আমি প্রথমেই গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই ব্যক্তিকে, যিনি আমাদেরকে একটি পতাকা এনে দিয়েছেন, যার জন্ম না হলে আমরা এই স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না, আজকে এখানে বসে কথা বলতে পারতাম না। সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের নিহত সদস্যদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। আমাদের জাতীয় চার নেতার মাগফিরাত কামনা করছি এবার এর সাথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বীর বাঙালি বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের ৫০ বছর পেরিয়ে আসার পথে আমরা। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও বাঙালির স্বাধীনতার রক্তলাল সূর্যোদয়ের ভিত্তি সূচিত হয়েছিল বেশ আগেই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্দীপ্ত বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ় শপথ নিয়েছিল। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্মম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলার দামাল ছেলেরা রুখে দাঁড়িয়েছিল শোষণের বিরুদ্ধে। এরপর টানা ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর আত্মদানের মাধ্যমে আসে কাক্সিক্ষত বিজয়। বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গৌরবদীপ্ত চূড়ান্ত বিজয় এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে বাঙালিরা। অর্জন করে নিজস্ব ভূ-খণ্ড। আর সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা। ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের মাধ্যমে ঘোষিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এ দিনে। এই বছর এই বিজয় মাসের প্রাক্কলে আমরা আরও একটি অর্জন অর্জিত করেছি। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের সুপারিশ জাতিসংঘের অনুমোদন পেয়েছে। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ হিসেবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ৩টি মানদণ্ডই পূরণ করেছে। ১৭ নভেম্বর ২০২১ তারিখে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম বৈঠকের ৪০তম প্ল্যানারি সভায় এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হয়। এটি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প ২০২১-এর বাস্তবায়ন। আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। অনেকেই এই অর্জনকে বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রার এক মহান মাইলফলক হিসেবে অভিহিত করেছেন। অনেকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণে তার কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব সাফল্য বলেও উল্লেখ করেন।
এফ এম শাহীন বলেন, নিশ্চয় একটা দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে আমরা একটি ভিন্ন সময় উপভোগ করছি। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্য দিয়ে এবারের উদযাপনের বাহ্যিক রুপটা একটু ম্লান হয়েছে। এবারের আয়োজনকে অনেক সীমিত আকারে করতে হচ্ছে আমাদেরকে। এটি নিশ্চয় আমাদের জাতির জন্য একটি গৌরবের বিষয়। আজকে এমন একটা সময়ে বাংলাদেশ ৫০ বছরকে স্পর্শ করলো যখন জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছি এবং করছি। সারা পৃথিবী জানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে একটি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে, ২৩ বছর সংগ্রাম করে একটি জাতিকে কিভাবে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সেদিন যদি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবন বাজি রেখে যদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করতো তাহলে এই ৫০ বছরে এসে কিন্তু আমরা এই স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারতাম না। একটি জাতির গৌরব সেই দেশের স্বাধীনতা এবং আমাদের দেশে স্বাধীনতা এসেছে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের শ্রোতের বিনিময়ে। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান। ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ’৫৬-এর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ’৫৮-এর মার্শাল ’ল বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফার আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থান, ৬-দফা ভিত্তিক ’৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে অবধারিত করে তোলে। এই সব আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতেই তাকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত বাংলাদেশের সরকারের অধীনে পরিচালিত দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয় অর্জনে মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষায় এই বিজয় অর্জিত হয়। কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও গৌরবগাঁথা গণবীরত্বে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় বাঙালি জাতি।