
নানাভাবে সমালোচিত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান উত্তরা ফাইন্যান্স আগের বছরের তুলনায় বেশি মুনাফা করেছে। করোনা মহামারির মধ্যেও প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়ী সফলতার পাশাপাশি ধরে রেখেছে লভ্যাংশের ধারাবাহিকতা। শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটির সবধরনের সূচকেই ছিল রেকর্ড পরিমাণ সাফল্য। করোনার মধ্যেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচকে উন্নতি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজের মেধা দিয়ে অল্প সময়ে মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির নানা সাফল্য বয়ে এনেছেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি যে অনিয়ম ছিলো তা তিনি এর মধ্যে সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে আছেন এস এম শামসুল আরেফিন। প্রতিষ্ঠানটির আগামীর পদক্ষেপ জানতে দৈনিক ভোরের পাতার প্রতিনিধি রমজান আলী’র মুখোমুখি হয়েছিলেন এস এম শামসুল আরেফিন। ভোরের পাতাকে তিনি যা বলেছেন তার চুম্বক অংশ আমাদের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
ভোরের পাতা: বর্তমানে আপনার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা কী?
এস এম শামসুল আরেফিন: এখন আমরা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। গতকয়েক বছর ধরে এই খাতে বেশকিছু সমস্যা দেখতে পাচ্ছিলাম। কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের ঋণ কেলেঙ্কারি, বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচার, যার একটা বড় প্রভাব পড়েছে সার্বিক আর্থিক খাতে। এক্ষেত্রে আর একটি বড় সমস্যার নাম বিশ্বজুড়ে কোভিড আতঙ্ক। কোভিডের কারণে গ্রাহকদের লোনের কিস্তি দিতে হয়নি। ফলে ক্যাশ ফ্লোর একটা বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তার ওপর নতুন ডিপোজিট পাচ্ছিলাম না। কিস্তি ফেরত না পেলেও জামানতকারীদের টাকা দিতে হচ্ছিল নিয়মিত। সব মিলিয়ে একটা অস্থির অবস্থা ছিল সার্বিক আর্থিক খাতে। তবে এখন ধীরে ধীরে সেটা কাটিয়ে উঠছি। খুব দ্রুতই এই অবস্থা কাটবে বলে মনে করছি।
ভোরের পাতা: গ্রাহকদের কাছ থেকে কিস্তির টাকা পাচ্ছিলেন না, কিন্তু আমানতকারীদের মাসিক টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এই নাজুক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আপনার পদক্ষেপ বিষয়ে কিছু বলুন?
এস এম শামসুল আরেফিন: করোনার মধ্যে অনেক আমানতকারীদের পুরোটাকাই দিতে হয়েছে। অনেক বলছে টাকা না দিতে পারলে তারা আন্দোলনে যাবে বলে হুমকি দেয়। তাই আমানতকারীদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হয়েছে। এগুলো সামাল দিতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তারপরেও কোম্পানির কমিটমেন্ট পুরনে আমরা সক্ষম হয়েছি। এই অচলঅবস্থা কাটিয়ে ওঠার ফলে আমাদের ভেতরে একধরনের বিশ্বাস জন্মেছে আমরা হারব না জিতবো ইনশা আল্লাহ। বর্তমানে আমাদের মনোবল চাঙ্গা বিধায় আমরা বিশ্বাস করি খুব দ্রুতই আমরা তা কটিয়ে উঠতে পারব।
ভোরের পাতা: গ্রাহকদের সেবা বিষয়ে কিছু বলুন?
এস এম শামসুল আরেফিন: আমরা কিন্তু ব্যাংক নই, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানের মডেল হওয়া দরকার- ব্যাংকের কাস্টমারকে আমাদের কাস্টমার করা। ব্যাংকের মাধ্যমেই তাকে আমাদের সেবা দিতে হয়। আমরা কিন্তু কাস্টমারকে সরাসরি টাকা দিতে বা তার টাকা নিতে পারি না। অ্যাকাউন্ট খুলতে পারি না। যার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে, তার সেকেন্ড রিলেশন হিসাবে আমরা ব্যবসা করতে পারি। তাই যদি কাস্টমারকে ব্যাংকের থেকেও এক্সট্রা ভেল্যু অ্যাড করতে পারি, তাহলেই তিনি আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করবেন। অনেক বেশি ইন্টারেস্ট দিয়েও আপনি গ্রাহককে লম্বা সময় ধরে রাখতে পারবেন না। দেশে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বেশি রেটে ডিপোজিট নিচ্ছেন এবং লোন দিচ্ছেন। এতে ঋণখেলাপী বাড়ছে বেেল আমরা মনে করি। আমরা তা না করে খুবই ইনোভেটিভ ওয়েতে গ্রাহককে বৈচিত্র্যময় এবং লাভজনক প্রোডাক্ট (গ্রিণ আর এগ্রো ফাইন্যান্সিং) অফার করছি। ইউনিক সার্ভিসের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছি। নিবিড় যোগাযোগ করছি। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সুসম্পর্ক নিয়মিত উন্নত রাখছি।
ভোরের পাতা: দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি বলে মনে করেন কী?
এস এম শামসুল আরেফিন: নিঃসন্দেহে বেশি। নির্দিষ্ট এলাকায়, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য যতগুলো ব্যাংক থাকা দরকার, সে হিসাবে মানে ব্যাংকের ঘনত্ব হিসাবে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যাংকের শহর বললে অতুুক্তি হয়না। আপনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে খোঁজ নিয়ে দেখুন, সেখানকার বড় বড় শহরে আপনি ১০ থেকে ১৫টার বেশি ব্যাংক দেখবেন না। অথচ আমাদের প্রায় ৬২টা ব্যাংক আর ৩৫টা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। আমাদের এখানে এন্ট্রি ডোর অনেক বড়। কিন্তু বেরুনোর রাস্তা নাই। ফলে অনেকগুলো ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বেশ কঠিন সময় পার করছে। তারপরও মানুষের আস্থা চলে যাবে বলে যারা সমস্যায় আছেন, তাদের কোনো বেরুবার পথ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে না। দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে।
ভোরের পাতা: আপনার প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকসেবার মান যথেষ্ট বলে মনে করেন কি? আর গ্রাহক সন্তুষ্টির বিষয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা যদি একটু বলতেন?
এস এম শামসুল আরেফিন: প্রকৃত সত্যটি হচ্ছে আমাদের ব্যবসা নির্ভর করে গ্রাহক সন্তুষ্টির উপর। আমরা গ্রাহককে কতটা সন্তুষ্ট করতে পারছি সেটিই এখানে মুখ্য। আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানের কেবল প্রচুর টাকা থাকলেই যে, ভালো ব্যবসা করতে পারবো- তা নয়। এরকম প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেরই ভালো, অভিজ্ঞ জনবল আছে। সুসজ্জিত অফিস আছে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে-কাস্টমার আমাকে প্রেফার করছেন কি না, তিনি অন্য প্রতিষ্ঠান রেখে আমার এখানে কেন আসবেন? মনে রাখতে হবে, কাস্টমার আমার কাছে আসা মানে আমি তাকে ফেভার করছি না, তিনি আমাকে ফেভার করছেন। অন্য ৪০/৫০টা প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে আমার প্রতিষ্ঠানে এসেছেন। কাস্টমারের ফেভার পাওয়ার জন্য তার সন্তুষ্টির প্রতি সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। এই বিষয়ে আমরা খেয়াল একই সঙ্গে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ভোরের পাতা: কিছু কোম্পানি খুব সহজে ঋণ পাচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি বা দেউলিয়া হচ্ছেন? বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
এস এম শামসুল আরেফিন: আসলে খেলাপিঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের যে পলিসি বা দেশের যে আইন, তা কিন্তু সবার জন্য সমান। সেটা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান-যাই বলুন না কেন। ব্যক্তির জন্য খুব কড়াকড়ি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ছাড়- এরকম কোন বিষয় না। আপনি কয়েকটা বিষয় খেয়াল করলেই দেখবেন, প্রতিষ্ঠান বা বড় বড় ঋণখেলাপি যারা আছেন, তাদের কেউ কেউ হয়তো বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে বা আইনের ফাঁক-ফোঁকর খুঁজে সময় চেয়ে নিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আলটিমেটলি বেশিরভাগই সফল হতে পারেন না। এসব ঋণ আদায়ে হয়ত সময় লাগবে ২-৪ বছর। বড়জোর ৫ বছর। কিন্তু একটা সময় আপনাকে (ঋণখেলাপি) কিন্তু ধরা দিতেই হবে। আর ব্যক্তি যারা ঋণ নেন, সে টাকার অঙ্ক অনেক ছোট। তাদের ক্যাপাসিটি থাকে না, আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবার। তারা কোর্টে গিয়ে রিট করা বা স্টে অর্ডার নিতে পারেন না। যে সুযোগটা বড় ঋলখেলাপিরা নিয়ে থাকে। যে কারণে ব্যক্তি ঋণগ্রহীতার প্রতি ব্যাংক বেশি প্রভাব খাটাতে পারে। কিন্তু নিজে একজন ব্যাংকার হিসেবে যদি বলি, আমার কাছে সব ঋণগ্রহীতাই সমান। আমি কাউকে লিবারেলি আবার কাউকে কড়া ভাবে দেখি-তা কিন্তু না। তবে এটা ঠিক ব্যবসায়িক কারণে প্রাইসিংয়ের ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে কিছু তারতম্য ঘটতে পারে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তি ঋণগ্রহীতার রিস্ক বেশি, অপারেটিং মনিটরিং কস্ট বেশি বলে তার ক্ষেত্রে হয়তো রিস্ক প্রিমিয়াম অ্যাড করে ১ পারসেন্ট বেশি দিচ্ছি। কিন্তু ঋণ আদায় বা কড়াকড়ির ক্ষেত্রে উভয়ের জন্যই সমান ব্যবস্থা নিই আমরা। ঋণখেলাপি কেন হচ্ছে, এটা আমাদের জানতে হবে। কেবল আমাদের দেশে নয়, এই কালচারটি কেবল আমদের দেশে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। বিশ্বের অনেকে দেশেই হচ্ছে। হয়তো আমাদের তুলনায় তাদের হার অনেক কম। ঋণ দেওয়ার সময় আমরা যদি সঠিকভাবে রিস্ক অ্যাসেসমেন্টটা না করতে পারি, যদি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী অসৎ হয়, অসাধু পন্থায় যদি ঋণগ্রহীতার সাথে হাত মেলায়, বা কোনো প্রভাবের কারণে ঋণ দিতে বাধ্য হয়- সেক্ষেত্রে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়ে যাবে এটিই সত্যি।
ভোরের পাতা: আপনার বর্তমান পরিকল্পনা সর্ম্পকে যদি বলতেন...
এস এম শামসুল আরেফিন: প্রতিষ্ঠানের কিছু সমস্যা ছিলো। সম্প্রতি আপনারা তা জানতে পেরেছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কিছু অনিয়ম হয়েছে। এখন প্রধান কাজ হলো সেই সব সমস্যা সমাধান করা বা সেই সময়টাকে পাড়ি দেওয়া। তবে এরই মধ্যে ৯৫ শতাংশ ঝামেলা সমাধান হয়েছে। বাকী ৫ শতাংশ অল্প সময়ের মধ্যে করে ফেলতে পারবো বলে আশা করছি। প্রতিটি মানুষের একটি লক্ষ্য থাকে। আমার একটাই লক্ষ্য তা হলো উত্তরা ফাইন্যান্সের আগের সুনাম ফিরিয়ে আনা। এছাড়া আমাদের এখন ৫শ কোটি টাকা দরকার। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক যদি আমাদের ৫শ কোটি টাকা ঋণ দেয়, তাহলে আমরা আবার আগের মত সব কার্যক্রম শুরু করতে সক্ষম হব। এছাড়া ঋণ খেলাপি কমিয়ে আনতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রয়েছে ৯ শতাংশ তবে আরো কমে আসতো করোনা না থাকলে।