
গরুর চামড়া ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকার মধ্যে হতে পারে
এখন পর্যন্ত বর্জ্য পরিশোধনাগার পরিপূর্ণভাবে তৈরি হয়নি
গত বছরের ৪০-৪৫ শতাংশ চামড়া এখনও অবিক্রিত রয়েছে
বর্গফুট গরুর ২ ডলার এখন দেড় ডলার দামে রফতানি হচ্ছে
চট্টগ্রামে ২২টি ট্যানারির মধ্যে বন্ধ ২১টি
চোখ রাঙাচ্ছে গতবছরের অভিজ্ঞতা
আসন্ন কোরবানির ঈদে চামড়া সংগ্রহ ও বাজার নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে দেশের চামড়া ব্যবসায়ীরা। গতবছরে ঈদে চামড়া ব্যবসায়ীরা বিক্রি করতে না পেরে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছে। এতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। এবারেও সেই আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীরা জানান, সরকার সাভারে চামড়া শিল্পের ব্যবস্থা করবার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেখানে এখনও পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু হয়নি। এছাড়া এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে পারেনি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গত বছরের ৪০-৪৫ শতাংশ চামড়া এখনও অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। চামড়া শিল্পের দীর্ঘদিনের মন্দা ও করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কম। বেশি দামে চামড়া কিনলে গত বছরের মতো বিপদে পড়তে হবে। তাই এবারে চামড়া কেনা নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে তারা। এবারে মাঠ পর্যায়ে প্রতিটি গরুর চামড়া ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকার মধ্যে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, করোনার মধ্যে চামড়া শিল্প ঘুরে দাড়ালেও এখন পর্যন্ত বর্জ্য পরিশোধনাগার পরিপূর্ণভাবে তৈরি হয়নি। ফলে আশানুরূপভাবে রফতানি করা যাচ্ছে না চামড়া শিল্প। করোনার কারণে ট্যানারি মালিকরা মূলধন সংকটে আছে। চামড়া নিয়ে অনিশ্চয়তা কতটা কমানো যায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও আমরা কাজ করছি। পাশাপাশি অন্যান্যবারের মতো এবার যেন চামড়া নিয়ে বড় কোনো সংকট তৈরি না হয়, সে বিষয়ে কাজ করছি। তিনি আরো বলেন, দফায় দফায় লকডাউনের কারণে ইউরোপে চামড়ার বাজার এখনো স্বাভাবিক হয়নি। বাজার স্বাভাবিক হলে, চামড়া রফতানি বাড়বে। আর ক্রেতারা পণ্য নিলে ট্যানারি মালিকরাও আটকে যাওয়া মূলধন বিনিয়োগ করতে পারবে।
বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। সদ্য শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি বেড়েছে ২.৩ শতাংশ আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে ১৮% শতাংশ। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে লেদার ও লেদার ফুটওয়্যার রফতানি যথাক্রমে বেড়েছে ৩.৬ শতাংশ ও ৫.৫৩ শতাংশ। আর লেদার পণ্য রফতানি কমেছে ৪.৬৬ শতাংশ। এদিকে ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চার বছরের ঋণের সুদ মওকুফ চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন।
ট্যানারি মালিকরা চামড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি করে। ব্যবহার উপযোগী করার পর একটি অংশ সরাসরি রফতানি হয় আর একটি অংশ দিয়ে চামড়াজাত পণ্য তৈরি হয়। যা দেশে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি করা হয়। গত বছর কোরবানির কাঁচা চামড়া নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। কাঁচা চামড়ার দাম আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কমানো হলেও কম দাম ও ক্রেতা না থাকায় অনেকে মাটিতে পুঁতে ফেলে। গত বছর ঢাকায় গরুর চামড়া প্রতিবর্গ ফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা দাম নির্ধারণ হয়েছে। এছাড়া প্রায় ২৭ শতাংশ দাম কমিয়ে প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ টাকা।
ব্যবসায়ীরা জানান, আড়তগুলোতে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ২৫-৩০ টাকা, মহিষ ২০-২৫ টাকা, ছাগল (খাসি) ১৮-২০ টাকা এবং ছাগল (ছাগি) ১২-১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২০১৯ সালে একই সময়ে এই চামড়ার দাম ছিল গরু ৩৫-৪০ টাকা, মহিষ ২৫-৩০ টাকা এবং ছাগল ২০-২৫ টাকা। এর আগের বছরগুলোতে এসব চামড়ার দাম আরো বেশি ছিল। ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড় বাজার হলো জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, রাশিয়া, ব্রাজিল, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। কিন্তু এসব দেশে চামড়া ও চামড়া জাতীয় দ্রব্য বিক্রি হচ্ছে আগের চেয়ে শতকরা ২০ শতাংশ কম দামে। এর প্রভাব পড়েছে দেশীয় চামড়া শিল্পেও। গত বছর বিদেশের বাজারে প্রতি বর্গফুট গরুর প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানি হয়েছে ২ ডলারেরও বেশি দামে। এক বছরের ব্যবধানে এখন দেড় ডলার দামে রফতানি হচ্ছে।
এছাড়া দেশের চামড়া শিল্পের কাঁচামালের বড় যোগান আসে চট্টগ্রাম থেকে। ফলে গত তিন দশকে চট্টগ্রামে ২২টি ট্যানারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরের চামড়ার টানা দরপতনে ব্যবসায় লোকসান ও ইটিপি স্থাপন করতে না পারায় ২১টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেটি শতভাগ ইটিপি চালু করে চামড়ার ব্যবসা পরিচালনা করছে। এতে চট্টগ্রামের চামড়ার ব্যবসা এই একটি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকায় ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে কম দামে ও বাকিতে চামড়া বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ), রিসার্চ পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (আরএপিআইডি) এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ওয়েবিনারে সালমান এফ রহমান বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে পোশাক খাত বাংলাদেশে একটি সফল খাত। সরকার পোশাক খাতকে যে যে সুবিধা দিয়েছে, একই সুবিধা চামড়া খাতকে দিলে তারাও সফল হবে। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি বোঝার জন্য তো কমন রকেট সায়েন্স লাগে না। এটা কমনসেন্সের বিষয়। আমি বাণিজ্যসচিবকে অনুরোধে করে বলছি, চামড়া খাতকে সমান সুবিধা দেওয়ার জন্য। যেটা এখন পোশাক খাতকে দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংক বলেছে, সমান সুবিধা পেলে চামড়া খাত থেকে বছরে এক হাজার ডলার পণ্য রফতানি হবে। আমি মনে করি পণ্য রফতানি এক হাজার ডলারের বেশি হবে। তিনি আরো বলেন, এটা সত্য, সাভারে চামড়া শিল্পনগরে আমরা এখনো কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে পারিনি। কারণ, যে ঠিকাদারকে কাজটা দেওয়া হয়েছিল, তাদের ভুল ছিল। আমি মনে করি তার চেয়ে বড় দোষ হলো পরামর্শক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)। পরামর্শক তার কাজটা করতে পারেনি। সাংঘাতিক ক্ষতি করেছে বুয়েটের পরামর্শক।
ওয়েবিনারে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, ‘সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে সিইটিপি বসানো নিয়ে দুই দশক ধরে কথা শুনে আসছি। এটা নিয়ে কত সেমিনার, কত কথা হয়েছে। অতীতে যেসব ভুল হয়েছে, তা নিয়ে আর কথা না বলি। চামড়া খাত নিয়ে একটা রোডম্যাপ করা জরুরি। একই সঙ্গে সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কেন কাজটি আপনি করতে পারলেন না, তার জবাব দিতে হবে।’ ওয়েবিনারে বাণিজ্যসচিব বলেন, দেশে চামড়াশিল্পের যথেষ্ট কাঁচামাল থাকলেও এই খাত এখনো বিকশিত হতে পারেনি। সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো চালু হয়নি। কাঁচামাল থাকলেই হবে না, এর গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে প্রচুর রাসায়নিক ব্যবহার হয়। শ্রমিকের অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশদূষণ বন্ধ করতে হবে। এসব কাজ করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই চামড়া খাতের রফতানি বাড়বে।
ওয়েবিনারে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হাজারীবাগে আমাদের রেখে যাওয়া জমি রাজউক ‘রেড জোন’ করে রেখেছে। এটিকে সবুজ জোন করতে দিনের পর দিন বলে আসছি। ১৫ মাস হতে চলল। এখন পর্যন্ত রাজউক হাজারীবাগের জমিকে সবুজ জোন ঘোষণা করেনি। ওই জমিকে সবুজ জোন ঘোষণা করলে সে জমি বিক্রি করে আমরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারতাম।’ কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তার কারণে চামড়া খাত পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ওয়েবিনারে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, সরকারের কাছ থেকে নীতিসহায়তা পেলে চামড়া খাতের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। পোশাকের সঙ্গে চামড়া খাতের বৈষম্য বিরাজমান থাকায় চামড়া খাত পিছিয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘সাভারে সিইটিপি তৈরি না করেই আমাদের সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ ব্যাংক থেকেও চাহিদামাফিক ঋণ পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেন তিনি। ওয়েবিনারে বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, পোশাক খাতের মতো চামড়া খাতকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা দিতে হবে। তাহলে এই খাতে রফতানি বাড়বে।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশে কাদের লেদার কমপ্লেক্সের অনুকূলে হংকং, চীন, কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, ইতালি, স্পেন ও জার্মানিতে ২০ লাখ বর্গফুট ‘ওয়েট ব্লু’ চামড়া রফতানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ট্রেডিং কোম্পানি ‘এএসকে ইনভেস্টমেন্টকে’ কেবলমাত্র চীনে ২০ লাখ বর্গফুট চামড়া রফতানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কালাম ব্র্রাদার্সকে হংকং, চীন, কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, ইতালি, স্পেন ও জার্মানিতে ২০ লাখ বর্গফুট ‘ওয়েট ব্লু’ চামড়া রফতানির অনুমোতি দেওয়া হয়। লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের ‘ইউনিট-২’কে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, চীন, রাশিয়া, ইউক্রেন, হংকং, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও জাপানে সর্বোচ্চ ২০ লাখ বর্গফুট চামড়া রফতানির অনুমোদন দেওয়া হয়। আমিন ট্যানারিকে হংকং, চীন, কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, ইতালি, স্পেন ও জার্মানিতে ২০ লাখ বর্গফুট চামড়া রফতানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ভোরের পাতা/পি