শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটালাইজেশনে রূপান্তরিত করতে হবে:ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ#আমাদের শিক্ষাখাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আরও বাড়াতে হবে:ড. সরিফা সালোয়া ডিনা#বর্তমানে স্কুল খুলে দিলে আমাদের সন্তানরা জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে:ড. মো. আফজাল হোসেন

আমরা সবাই মিলে আজকে যে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হাজির হয়েছি সেটা নিয়ে এখন আলোচনা করা সময়ের দাবি। বর্তমানে আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি তার থেকে উত্তরণ হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে এডপ্ট পলিসি নির্ধারণ করা। আমাদের সবাইকে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে করোনা পূর্ব পৃথিবীতে আর কখনোই ফিরে যাওয়া সম্ভব না। করোনায় শিক্ষার ব্যবস্থার কথা বলতে গিয়ে আমি শুরুতেই যে কথা বলতে চাচ্ছি সেটা হল গত দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা দেশে যে পরিমাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচনা বা সমালোচনা হয়েছে যে বিষয়টিকে নিয়ে সেটা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া নিয়ে যতবেশি নেগেটিভ আলোচনা হয়েছে ততবেশি আলোচনা কিন্তু আর কোন বিষয় নিয়ে হয়নি। আমাদের আর পুরানো অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। এই অসহায় বিকল্প বা করুণ বিকল্পকে মেনে নিয়ে আমাদেরকে ডিজিটালাইজড হতেই হবে। এর বাইরে কোন পরিকল্পনা করা ছাড়া আমাদের কাছে আর কোন উপায় নেই। শিক্ষাখাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আরও বাড়াতে হবে।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৩৯৯তম পর্বে মঙ্গলবার আলোচক হিসেবে উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক, জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সরিফা সালোয়া ডিনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আফজাল হোসেন। দৈনিক ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, আমরা সবাই মিলে আজকে যে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হাজির হয়েছি সেটা নিয়ে এখন আলোচনা করা সময়ের দাবি। বর্তমানে আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি তার থেকে উত্তরণ হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে এডপ্ট পলিসি নির্ধারণ করা। আমাদের সবাইকে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে করোনা পূর্ব পৃথিবীতে আর কখনোই ফিরে যাওয়া সম্ভব না। আমাদেরকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে করোনা উত্তোরণ পরিস্থিতিতে করোনাকালীন সময়ে যে প্রণীত রণকৌশল অবলম্বন করে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি তা ভবিষ্যতে ধরে রাখা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য আমাদের প্রস্তুত হওয়া এবং এটি অবশ্যই ডিজিটাইলেজশনে হতে হবে। এনালগ মাইন্ড সেটআপ থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে স্থায়ীভাবে ডিজিটাল ব্যবস্থায় নিজেদেরকে উন্নীত করতে হবে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ হতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো করোনা মহামারির কারণে বন্ধ হতে শুরু করে। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের দেশেও সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গুটিকয়েক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংরেজি শিক্ষা মাধ্যম স্কুলগুলো শুরু হতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিলেও পরবর্তীতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে থাকে। তবে সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী ক্লাস রুমের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তাই আমাদের অনলাইন পাঠদান ও অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণ কমপ্রিহেনসিভ ভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এটা সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করলে চলবে না। সেজন্য যেখানে যতটুকু প্রয়োজন সেটাকে আমাদের রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা ভর্তুকি নানান ক্ষেত্রে দিয়ে থাকি, এখানে শিক্ষা সব থেকে বড় ক্ষেত্র হতে পারে। আমাদের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত শিক্ষার্থীরা এক পর্যায়ের হয় না। সে বাস্তবতাটা মাথায় আমাদের বিষয়ভিত্তিক সমাধানে আসতে হবে। এবং এই ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একযোগে টিম হিসেবে কাজ করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক রকম ফের আছে। যেমন আমাদের বেগম রকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি রিলেটেড বিশ্ববিদ্যালয়। আবার ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরও গোটা কয়েক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে ৭৩ অধ্যাদেশ অনুসারে পরিচালিত হয়। অতএব আমাদেরকে এখনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাইলেজেশনে রূপান্তরিত করতে হবে।
অধ্যাপক ড. সরিফা সালোয়া ডিনা বলেন, করোনায় শিক্ষার ব্যবস্থার কথা বলতে গিয়ে আমি শুরুতেই যে কথা বলতে চাচ্ছি সেটা হলও গত দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা দেশে যে পরিমাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচনা বা সমালোচনা হয়েছে যে বিষয়টিকে নিয়ে সেটা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া নিয়ে যতবেশি নেগেটিভ আলোচনা হয়েছে ততবেশি আলোচনা কিন্তু আর কোন বিষয় নিয়ে হয়নি। অভুক্তরা খেতে পারবে কিনা বা তাদের কি প্রয়োজন, চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিকা প্রদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বার্তা হয়েছে বটে কিন্তু শিক্ষা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ট্রল হয়েছে। আমরা যারা শিক্ষাবিদ ও পরিকল্পনাবিধ আছি তারা কিন্তু এই করোনায় যখন ঘরে ছিলাম তখন কিন্তু আমরা দিনরাত চিন্তা করেছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু অন্য যারা বসেছিলেন তারা তাদের উর্বর মস্তিষ্ককে কোন সুপরিকল্পিত কাজে মনোনিবেশ না করে তারা নিজেদেরকে একটা নেগেটিভ চিন্তায় নিয়োজিত রেখেছেন। যেটা আমাদের জন্য যথেষ্ট দুঃখজনক। সরকার সবদিক থেকেই বিবেচনা করেই বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে এবং আমরা জানি জাতীয় যে পরামর্শক কমিটি রয়েছে তারা যে পরামর্শ দিয়েছেন তাতে তারা লকডাউনকে আরও বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা নিয়োজিত তাদেরকে দেশের অর্থনীতি পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হয়, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে করতে হয় এবং গত ঈদের যে যে নেগেটিভ বিষয়গুলো আমরা মিডিয়াই বা পত্রিকায় দেখেছি সেটা দেখেও একটা নতুন বিবেচনা নিতে হয় সরকারকে। ক্ষুদ্র এক ভাইরাস আমাদের পৃথিবীর গতি হঠাৎ এভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারে, তা ছিল কল্পনার বাইরে। পৃথিবীর আগামী কর্মপরিকল্পনা, ধ্যান-ধারণা বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং যোগাযোগের ধরন। সেই সাথে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে যখনই কোন মহামারি তৈরি হয়েছে, তখন নতুন চ্যালেঞ্জসহ নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ঠিক তেমনি করোনাভাইরাস আমাদের শিখিয়েছে, কীভাবে সচল পৃথিবীতে হঠাৎ আসা মহামারির স্থবিরতা প্রযুক্তির দ্বারা সচল রাখতে হয়, কিভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৈশ্বিক মহামারির ক্ষয়-ক্ষতি কমানো যায়। সরকার এক্ষেত্রে যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে সেখানে অবশ্যই আমাদেরকে প্রযুক্তিগত বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে। এই মহামারির মধ্যে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। আমাদের আর পুরানো অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। এই অসহায় বিকল্প বা করুণ বিকল্পকে মেনে নিয়ে আমাদেরকে ডিজিটালাইজড হতেই হবে। এর বাইরে কোন পরিকল্পনা করা ছাড়া আমাদের কাছে আর কোন উপায় নেই। শিক্ষাখাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আরও বাড়াতে হবে।
ড. মো. আফজাল হোসেন বলেন, করোনা বর্তমানে একটি বৈশ্বিক ইস্যু। মজার ব্যাপার হচ্ছে বিশ্বের সবথেকে উন্নত দেশগুলোকে এটা সবার আগে পরাস্থ করেছে। গত বছর ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী বাংলাদেশে ধরা পরে এবং ১৮ মার্চ তিনজন করোনা রোগী মারা গেছে। সেসময় মিডিয়াগুলো বলেছিল বাংলাদেশে মত এত ঘনবসতি একটি দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে যেভাবে পাখির মত মানুষ মারা গেছে ঠিক একইভাবে এই করোনাকালীন সময়ে মানুষ মারা যাবে। কিন্তু আশার কথা হলও আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনার একান্ত উদ্যোগে এবং তাদের যে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রয়েছে সেগুলোর কম্ভাইন্ড উদ্যোগে আমরা বেশ ভালো অবস্থানে ছিলাম। প্রথম ঢেউতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের অবস্থা অনেক ভালো ছিল। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনাকালীন সময়ে প্রাণঘাতীর পরে অন্য যে বড় ক্ষতির সম্মুখীন আমরা হয়েছি তা হলো শিক্ষার ক্ষতি। আর্থিক, ব্যবসায়িক ও অন্যান্য ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে, কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি ও শিক্ষাজনিত কিছু কিছু পরোক্ষ ক্ষতি কি পুষিয়ে নেওয়া ততটা সম্ভব হবে না। যেমন শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, শিক্ষকতা পেশা থেকে ঝরে পড়া, শিশুর প্রথম শিক্ষার বিড়ম্বনা, বাল্যবিয়ে, উচ্চশিক্ষা ও চাকরি থেকে বঞ্চিত হওয়া, শিক্ষার প্রতি অনীহা ও অনাস্থা, শিক্ষার মর্যাদার সংকট, সৃজনশীল ও মেধা বিকাশের জট, মানসিক শিক্ষার সংকট, মানবিক শিক্ষার ঘাটতি ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের শিক্ষার অভাব। আবার যদি দীর্ঘমেয়াদি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সঠিক বাস্তবায়ন হয়, হয়তো তাহলে কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হতে পারে। এখনো প্রতিটি দেশ করোনা মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে, কিছু কিছু দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে বা দিলেও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে পরক্ষণেই আবার বন্ধ করছে। সংকটের কথা চিন্তা করে অধিকাংশ দেশ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে। কেউ কেউ আবার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে খুলতে চাইলেও পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় খুলতে পারছে না। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি ডিজিটাল এডুকেশন গড়ার নিরন্তর প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করার জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের সময় এখনই। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সমন্বয়ে যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা সম্পূর্ণ ডিজিটাল করতে পারলেই করোনা মহামারির এই বৈশ্বিক সমস্যা দ্রুত কাটিয়ে তোলা সম্ভব।
ভোরের পাতা/পি