
মহামারি করোনার মধ্যেও প্রবাসী আয়ে রেকর্ড হয়েছে। আর এই রেকর্ডে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে গড়েছে নতুন রেকর্ড। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪৬.০৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। রফতানি হচ্ছে খুব কম। এমন নানা সংকটের মধ্যেও রিজার্ভে রেকর্ড গড়ে চলেছে।
সৌদি আরবের রিয়াদে থাকেন বাংলাদেশের চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ইকবাল হোসেন। লকডাউন ও করোনার জের ধরে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি পার করে গত সতেরই জুন গ্রামের বাড়িতে বাবার কাছে টাকা পাঠিয়েছেন তিনি এবং এবার একটু বেশি পরিমাণেই পাঠানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। এই দুঃসময়েও টাকা পাঠিয়েছেন যাতে বাবা-মা ও পরিবার কোনো সমস্যায় না পড়ে। তিনি বলেন, ‘দেশের এই অবস্থায় তারা যেন সুন্দরভাবে চলতে পারে। বেশি করে টাকা পাঠিয়ে এমনকি আমি বাবাকে বলেছি যে আশেপাশের লোকজন যারা সংকটে পড়েছে তাদেরকেও যেন কিছুটা সহায়তা করেন।’
সৌদি আরবেই গৃহপরিচারিকার কাজ করেন লাভলী খাতুন। মার্চ ও এপ্রিল মাসে তিনি বাড়িতে টাকা পাঠাননি। কিন্তু জুনের প্রথম সপ্তাহে তিনি বাড়িতে থাকা তার বাবা ও মায়ের কাছে থাকা দুই সন্তানের জন্য বেশি করে টাকা পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দু মাস পাঠাইনি। আবার সামনে ঈদ আসছে। তাই ভাবলাম এই সুযোগে একটু বেশি করে পাঠাই। নিজের জমানো কিছু ছিলো আর রিয়াদের কাছেই আমার এক আত্মীয়ও থাকে, ওনার কাছ থেকে ৫০০ রিয়াল ধার করে সব এক সাথে বাড়ি পাঠাইছি।’
ঢাকার দোহারের এক গ্রামে থাকা লাভলী বেগমের মা মনোয়ারা বেগম বলছেন, ‘মেয়ের কাছ থেকে টাকা না পেয়ে এপ্রিলে তাকে টাকা ধার করতে হয়েছিল। এখন অতিরিক্ত অর্থ পেয়ে আগে দেনা শোধ করেছেন। বাড়তি টাকাটা মেয়ে না পাঠালে তো বিপদে পড়ে যেতাম।’ এভাবেই নানা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের পাঠানো টাকা অর্থাৎ রেমিট্যান্সে তৈরি হয়েছে একটা নতুন রেকর্ড। যার ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে গতকাল। প্রবাসীদের অর্জিত এ অর্থেই জড়িয়ে আছে শ্রম, আবেগ ও স্বপ্ন। এ নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে দেশের রিজার্ভের গৌরব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান বলেন, ‘প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (গতকাল) আজ ৪৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তিনি বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।’ গতকাল বিকাল নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, প্রবাসীরা এই মাসের ২৮ দিনে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ১৭৫ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই- ২৮ জুন পর্যন্ত ১১ মাস ২৮ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ৪৫৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন এক হাজার ৮০৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত অর্থবছরের তুলনায় এই অর্থবছরে (১১ মাস ২৮ দিনে) প্রবাসী রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন ৩৬.৪০ শতাংশ। আর গত বছরের জুন মাসের ২৮ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৫ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের (জুলাই- মে) ১১ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ২৮৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ বা ৭৭৮ কোটি ডলার বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৬৩৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রবাসীরা গত মে মাসে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২১৭ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার। আগের বছরের মে মাসে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন ১৫০ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রবাসীরা গত এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২০৬ কোটি ৭০ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। যা আগের বছরের এপ্রিলের তুলনায় প্রায় ৯৭ কোটি ডলার বেশি। গত বছর (২০২০ সাল) এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার। গত মাসে ঈদ থাকায় প্রবাসীরা বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, এর আগে, করোনা ভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে গত বছরের জুলাই মাসে মাইলফলক রেমিট্যান্স পায় বাংলাদেশ। ওই মাসে প্রবাসীরা প্রায় ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে একক মাসে এতো রেমিট্যান্স আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের মার্চে মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯১ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে।
অবশ্য গত অর্থবছরের পুরো সময়ে এসেছিল এক হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অর্থাৎ কোনও প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে আরও ২ টাকা যোগ করে মোট ১০২ টাকা পাচ্ছেন সুবিধাভোগী। নতুন অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের বিপরীতে প্রণোদনা সহায়তা ৩ টাকা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।