
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী জাবেদ করিমকে ঘিরে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, অবসরে যাওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় নিয়োগ, পদায়ন ও বদলির মাধ্যমে প্রায় সাত কোটি টাকার বাণিজ্যে জড়ান।
গত ৩ নভেম্বর রুটিন দায়িত্বে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পান জাবেদ করিম। মাত্র ২৭ দিনের এই মেয়াদে তাকে খুব একটা সক্রিয় দেখা যায়নি। সহকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি নিয়মিত অফিসে এলেও সীমিত কয়েকটি ফাইলে সই করে মধ্যাহ্নভোজ শেষে চলে যেতেন। অধিকাংশ সময়ই তার গন্তব্য ছিল মন্ত্রণালয়। তবে ২৬ নভেম্বর হঠাৎ করেই বদলে যায় চিত্র।
সপ্তম তলায় গোপন বৈঠক, বদলি ও নিয়োগের সই
সংস্থার একাধিক কর্মচারীর দাবি, ওই দিন জাবেদ করিম চুপিসারে এলজিইডি ভবনের সপ্তম তলায় তার পূর্বতন কার্যালয়ে যান। সেখান থেকেই নিয়োগ ও বদলি সংক্রান্ত একাধিক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। প্রশাসন শাখার সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী শফিক আহমেদ এসব প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ওই দিনই সহকারী প্রকৌশলী ও উপজেলা প্রকৌশলীদের একাধিক পদায়ন ও বদলি হয়। পাশাপাশি রুরাল ট্রান্সপোর্ট আপগ্রেডেশন প্রজেক্ট (আরইউটিডিপি)-এর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নির্বাহী প্রকৌশলী (প্রশাসন) ফারুক আহমেদকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
৩০ নভেম্বর, শেষ কর্মদিবসের দুপুরেও তিনি আরও কয়েকটি বদলির আদেশে সই করেন এবং সন্ধ্যায় বিদায় নেন।
সাত কোটি টাকার বাণিজ্য ও বিশেষ বরাদ্দের অভিযোগ
অভিযোগ রয়েছে, এসব বদলি, নিয়োগ ও পদায়নের মাধ্যমে কমপক্ষে সাত কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর আশায় তিনি এই অর্থ সংগ্রহে তৎপর হন। পাশাপাশি নিজ জেলা নোয়াখালীর সড়ক সংস্কারের জন্য ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
রুটিন দায়িত্বে থাকা একজন প্রধান প্রকৌশলীর এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আইনগত এখতিয়ার আছে কি না—সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরই আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দেয়নি।
শুরুটাই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, জাবেদ করিমের চাকরি জীবন শুরু থেকেই বিতর্কিত। কুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ থেকে বিএসসি পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগেই তিনি এলজিইডির রাজস্ব খাতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পান। অথচ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস বাধ্যতামূলক ছিল।
নিয়োগ বিধি অনুযায়ী, এমন অনিয়ম প্রমাণিত হলে চাকরি বাতিল, বেতন-ভাতা ফেরত ও শাস্তির বিধান থাকলেও তার ক্ষেত্রে রহস্যজনকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রাজনৈতিক প্রভাব ও দ্রুত উত্থান
২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় লক্ষ্মীপুরের জিয়া উল হক জিয়া স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। একই জেলার বাসিন্দা জাবেদ করিম তখন জুনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তাকে লক্ষ্মীপুর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তৎকালীন এলজিইডি প্রধান প্রকৌশলী শহিদুল হাসান বিষয়টিকে নিয়মবহির্ভূত ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলাবিরোধী বলে আপত্তি জানালেও মন্ত্রীর চাপের মুখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।
দুই বছরের পরিবর্তে প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি ওই দায়িত্ব পালন করেন এবং জেলার উন্নয়ন তহবিল ও আর্থিক ক্ষমতার বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন।
দুর্নীতির অভিযোগ, বিদেশযাত্রা ও রাজনৈতিক রং বদল
ওই সময়ে হাতে লেখা টেন্ডারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময় দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে তার নাম উঠে এলেও উচ্চশিক্ষার অজুহাতে দ্রুত তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
পরবর্তী ১৬ বছরের বেশি সময় আওয়ামী লীগ সরকার আমলেও তিনি ক্ষমতার বলয়ের কাছাকাছি ছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাতারাতি তিনি জাতীয়তাবাদী ঘরানায় নিজেকে পুনর্স্থাপন করেন।
প্রকল্প পরিচালক পদে কোটি টাকার অভিযোগ
বিভিন্ন সূত্রের দাবি, প্রকল্প পরিচালক হতে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। বদলি ও পদায়নেও নিয়মিত কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য ছিল তার নিত্যদিনের চর্চা।
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করতে ৪ ডিসেম্বর সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত আরইউটিডিপি প্রকল্প পরিচালক ফারুক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানালেও আর ফোন দেননি। একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
অভিযুক্ত জাবেদ করিমের মোবাইল নম্বরেও একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটি কল ফরওয়ার্ড অবস্থায় পাওয়া যায়।