
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও গণহত্যাকারীদের দৃশ্যমান বিচার এবং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতেই নির্বাচন হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন করতেই আমরা রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছি। তবে এই নির্বাচন হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন। কারণ, গণপরিষদ নির্বাচন ছাড়া নতুন সংবিধান বা সংবিধানের মৌলিক সংস্কার সম্ভব নয়।’
বরিশালে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা-কর্মী ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় নাহিদ ইসলাম এ কথা বলেন। নগরের ক্লাব রোডে বরিশাল ক্লাবের অমৃতলাল দে মিলনায়তনে এই সভার আয়োজন করা হয়।
সভায় নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘অনেকেই ন্যূনতম সংস্কারের কথা বলছেন; কিন্তু আমরা বলতে চাই, ন্যূনতম সংস্কার বলে কিছু নেই। এই সরকারের সময়েই সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করতে হবে। দেশের ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে এই সরকারকে এনেছে পরিবর্তন ও বিচারের আশায়। জনগণের প্রতি সেই ওয়াদা সরকারকে পূরণ করতে হবে।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ঐক্য অটুট রাখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক আরও বলেন, ‘সরকার যে সময়সীমা নির্ধারণ করেছে, সেই সময়ের মধ্যেই দৃশ্যমান সংস্কার এবং বিচারের মাধ্যমে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আমরা অটুট রাখব। গণ–অভ্যুত্থানের সঙ্গে আপস করে, এমন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হবে না। আমাদের ঐক্যের মূল ভিত্তি হলো, জুলাই গণ–অভ্যুত্থান, শহীদদের আকাঙ্ক্ষা এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা।’
সভায় আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বরিশাল ক্লাবের অমৃতলাল দে মিলনায়তনে
নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘ফ্যাসিবাদীরা পিছু হটলেও পুরোনো বন্দোবস্তের অনেক উপাদান আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা-চেতনার মধ্যে রয়েছে। আমরা আহ্বান জানাব, নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করতে সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের দিকে যেতে যাচ্ছি, সেই দিকে যেন আমরা যাই। কেননা, যারা পরিবর্তন চায়নি, তারা বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। পরিবর্তনের সঙ্গে যারা তাল মেলাতে পারবে না তারা হারিয়ে যাবে।’
ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে জড়িত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘পরিবর্তন সংস্কারের মধ্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সেই পুরোনো রাজনীতি আমরা চাই না। আমরা সত্যিকার অর্থে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বরিশালের শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বরিশালে আপনারা যেভাবে গণ-অভ্যুত্থানের সময় গুলির সামনে বুক পেতে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছেন, সেভাবেই দলকে সুসংগঠিত করতে কাজ করতে হবে। বরিশালকে দলের শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত করতে হবে।’
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নাগরিক পাটির মুখ্য সংগঠক হান্নান মাসুদ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা, যুগ্ম সদস্যসচিব মুজাহিদুল ইসলাম, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসচিব জাহিদ আহসান প্রমুখ। পরে নাহিদ ইসলাম জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা-কর্মীদের নিয়ে মতবিমিনয় সভায় অংশ নেন।
পটুয়াখালীতে জুলাই আন্দোলনে শহীদ হওয়া এক ব্যক্তির কলেজপড়ুয়া মেয়ে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে পরিবার। ওই কলেজছাত্রী ও তাঁর পরিবারের খোঁজ নিতে পটুয়াখালীতে আসেন নাহিদ ইসলামসহ জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই ছাত্রীর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে দুপুরে সেখানে যান নাহিদ ইসলামসহ নেতারা। বিকেলে নাহিদ ইসলাম ভুক্তভোগী ছাত্রীর বাবার কবর জিয়ারতের জন্য গ্রামের বাড়িতে যান। সেখানে বেশ কিছু সময় অবস্থান করেন। ইফতারের পর তিনি বরিশালে মতবিনিময় সভায় যোগ দেন।
মতবিনিময় সভায় দুপক্ষের হট্টগোল
এদিকে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পরে বরিশাল নগর ও জেলার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে নাহিদ ইসলাম ও কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন। সভা চলাকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতি শুরু হয়। এ সময় মঞ্চ থেকে একজন কেন্দ্রীয় নেতাকে মাইকে দুপক্ষকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা শান্ত হোন, না হয় আপনারা বহিষ্কার হবেন।’ পরে মিলনায়তনের দ্বিতীয় তলা থেকে নিচে নেমে দুপক্ষ একে অপরের দিকে তেড়ে আসতে দেখা যায়।
সভা সূত্র জানায়, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভাটি শুরুর প্রায় আধা ঘণ্টা পর এই হট্টগোল শুরু হয়। এ সময় সভাস্থলে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষ। তাঁরা নাহিদ ইসলামের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলা এবং বৈঠকের দাবি জানান। তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত নেতারা শিক্ষার্থীদের ওই অংশকে শান্ত করলেও কর্মসূচি শেষে নাহিদ ইসলাম চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে তাঁরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। এরপর আবার তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সভাকক্ষে। এ সময় মিলনায়তনে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ায় দুটি পক্ষ। একপর্যায়ে তাঁদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতিও হয়। সেখানে বরিশালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলার চেষ্টা করা হয়। ৩০-৪০ মিনিট ধরে উত্তেজনা চলার পর আবারও সভাস্থল ত্যাগ করার চেষ্টা চালান নাহিদ। এ সময় বিক্ষুব্ধরা তাঁর গাড়ি আটকে দেন। একপর্যায়ে বাধা পেরিয়ে নাহিদ ইসলামকে গাড়িতে তুলে দেওয়া হলে তাঁরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে এনসিপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা কেউ নাম উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে চাননি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশাল মহানগর কমিটির আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্টের দোসররা আমাদের কর্মসূচিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আজকের এই ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা তাদের চিহ্নিত করে রেখেছি। পরিকল্পনা করেই তারা আজ এই অনুষ্ঠান বানচালের জন্য এখানে এসেছিল।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এনসিপির কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। ঘটনার বিষয়ে জানার জন্য তাঁকে বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।