ধীরগতি কাজের কারণে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ৪০ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। এছাড়াও প্রকল্প কাজের জমি অধিগ্রহণে রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের সিন্ডিকেট। এসব কারণে গত ১০ বছরেও প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের যে বরাদ্দ রাখা ছিল তার মধ্যে অনেক প্রকল্পের ব্যয়সমন্বয়ের খবরও রয়েছে। এদিকে বেশকয়েকটি প্রকল্পের সময় বৃদ্ধি করে ব্যয়ও বৃদ্ধির সুপারিশ রয়েছে। তারপরেও যথাসময়ে রেল উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে এমন কোন গ্যারান্টিও নেই। ফলে রেল সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যাত্রীরা। সারা দেশে রেলপথ উন্নয়নে ঋণদাতা সংস্থার অর্থায়নে মোট এক লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তয়িত হচ্ছে। এর মধ্যে ৯১ হাজার ১৯১ কোটি ২২ লাখ অর্থ সহায়তা করেছে বিভিন্ন দাতা সংস্থা। বাকি ৫০ হাজার ৫০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা সরকারি ভাবে খরচের কথা রয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে রেলওয়ের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র।
এদিকে ধীরগতির কারণে ঋণের সুদের পরিমাণ ক্রমান্নয়ে বেড়েই চলেছে। যা প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রশাসনিক জটিলতা। জমি অধিগ্রহণ ঝামেলার কারণে তিন দফা মেয়াদ পিছিয়েছে আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ ডাবললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি। ২০১৪ সালে জুলাইয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে ৬ বছরের মধ্যে মানে ২০২০ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে জমি বুঝিয়ে দিতে তিন বছর চলে যায়। স্থানীয় প্রশাসনের সিন্ডিকেটের কারণে জমি অধিগ্রহণে প্রকল্পের অধিক সময় ব্যয় হয়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য ছিল সারা দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা। কিন্তু গত ১০ বছরে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও শেষ হয়নি। এর মধ্যে দুটি ফিজিবিলিটি স্টাডি ও একটি অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ হলেও বেশির ভাগ প্রকল্পই ঝুলে আছে। রেলওয়ের সূত্রের খবর, করোনার কারণে পিছিয়ে গেছে কাজ। আবার জমি অধিগ্রহণের ঝামেলাও কাজের গতি শ্লথ হয়েছে বলে দাবি তাদের। বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চে। এর আগেই ২০১৪-১৫ সালের মধ্যেই অধিকাংশ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের ব্যয় ও সময়। ফলে সরকারের বিপুল পরিমানের অর্থের অপচয় ঘটছে।
রেলওয়ে মেগা প্রকল্প দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথ নির্মাণ। প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০১০ সালে ১ জুলাই। ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১০ বছরেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয় নি। চার দফা মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে সময় নির্ধারণ করেছে কর্তৃপক্ষ। সময়ের সঙ্গে ব্যয়ও বেড়েছে। এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ৩৫ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। গত জুন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে খুলনা- মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে। ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ৩ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। চার দফা সময় বৃদ্ধি করে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা বেড়ে দঁাঁড়িয়ে তিন হাজার ৮০১ কোটি টাকা। প্রকল্পের ব্যয় তিন দফায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত ৩০ জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৮৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মৌলভীবাজারের-কুলাউড়া-শাহবাজপুর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্নির্মাণ প্রকল্প ও ৭০টি মিটার গেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ক্রয় প্রকল্পের। এই প্রকল্প দুটি ২০১১ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছরের কোন অগ্রগতি নেই বললেই চলে। ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি করা হয়েছিল রেলপথটি। এ রেলপথ দিয়ে ‘লাতুর ট্রেনে’ ভারতের করিমগঞ্জ পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা হতো। ২০০২ সালে এই রেলপথটি বন্ধ হয় যায়। ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটের অন্তর্ভুক্তির জন্য রেলপথটি পুনর্নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। তিন দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যয় ১১৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৬৭৮ কোটি টাকাতে ঠেকেছে। বিডার্স ফাইন্যান্স বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণের অর্থায়নে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন ক্রয়ের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১০ বছর আগে। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ইঞ্জিন ক্রয়ে বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হলেও এখনো ঋণ চুক্তি হয়নি। প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৯৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
প্রকল্পের ধীরগতি বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, চলতি বছরের জুনে রেলওয়ে অনেকগুলো প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে দুই বছর প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে। মহামারির কারণে যেখানে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল সেখানে প্রকল্পের কাজ কিভাবে হয়। তাই বাস্তবতা বিবেচনায় কিছু কিছু প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ব্যয় বাড়ানো হয় নি বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাধারণত প্রকল্প প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি সময় লাগলে অর্থনীতির কয়েকটি ক্ষতি হয়। দীর্ঘ সময় ধরে প্রকল্প চলমান থাকলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এতে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ। যেমন- যাত্রী ও ভোক্তার প্রকল্পের সেবা পেতে বিলম্ব হয়। প্রকল্পের ব্যয় বাড়ার কারণে ভাড়া ও পণ্য পরিবহনের ব্যয় বেড়ে যায়। তখন সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে সেবা দিতে হয়।
এদিকে জমি অধিগ্রহণে রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের সিন্ডিকেট এ বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, জটিল থেকে জটিল হয়ে পড়ছে প্রকল্পের জমিঅধিগ্রহণ। ক্ষতিগ্রস্তদের তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেয়াটায় এখন অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ এই ক্ষতিপূরণের অর্থের ৫-১০ শতাংশ ভাগ দিতে হয় স্থানীয় প্রশাসনকে। এর সঙ্গে রয়েছে ডিসি, এসিল্যান্ড, স্থানীয় রাজনীতি ব্যক্তিত্ব ও পুলিশ। জমি প্রকৃত মালিকের কাগজপত্র সব ঠিক থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তিতে না আসলে সে ক্ষতিপূরণ পায় না বলে তিনি জানান।
জমি অধিগ্রহণ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে অনেক সময় চলে গেছে। তাই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে জমি বুঝিয়ে দিতে দেরি হয়েছে। এছাড়া করোনার কারণে গত দুই বছরের প্রকল্পের তেমন অগ্রগতি হয়নি।’ তাই প্রকল্পে ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।