২০০৮ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের উপর নির্যাতন শুরু করে। বিগত ১৫ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮২৫টির বেশি মামলা করা হয়েছে এবং আসামি করা হয়েছে ৫০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে। মামলা এবং জেলে বন্দী রেখে রাজপথ থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিবৃত করতে না পেরে আওয়ামী লীগ আশ্রয় নিয়েছে বিনাবিচারে গুম-খুনের মতো জঘন্য হত্যাকাণ্ডে। বাংলাদেশের বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর তথ্যানুসারে, গত ১৫ বছরে ৭০০ এর বেশি মানুষ গুম করা হয়েছে যার মধ্যে ১৫০ জনের বেশি মানুষের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বিএনপি’র সংগৃহীত তথ্য বলছে কেবলমাত্র ‘বিএনপির সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা ও ৬০০ জনকে গুম করেছে সরকার’-(ডেইলি স্টার, ১৪-০১-২৩)।
বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের এই নির্যাতন ছিলো জামায়াত ইসলামীসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের উপরও। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিরোধী দল এবং মতের মানুষদের ঘর-বাড়ি, জমিজমা এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জবরদখল করে নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জামায়াত ইসলামীর অনেক নেতাকর্মীদের নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। “আওয়ামী সরকার জামায়াতের শীর্ষ ১১, শিবিরের ৫০০ নেতাকর্মী হত্যা করেছে। ২০ হাজার মামলা দিয়ে আমাদের নেতাকর্মীকে ঘরবাড়ি ছাড়া করা হয়েছে - ১০ অক্টোবর, ২০২৪-দৈনিক আমাদের সময়।” প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরও অধিক কেননা সাংবাদিক কিংবা মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা এসব তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে গুম, খুন, নির্যাতন এবং গ্রেফতারের শিকার হওয়ায় প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। আওয়ামী লীগের অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকায় সাংবাদিক সমাজকেও হতে হয়েছে গুম-খুন, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার। গত ১৫ বছরে ৬১জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে এবং নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৩ হাজার ৫৮৮ সাংবাদিক। সাংবাদিকদের ওপর হামলা,মামলা ও নির্যাতনের ৬৭ শতাংশ ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়িত ছিলেন। বাকি অধিকাংশ ঘটনায় জড়িত হেলমেট পরিহিত আওয়ামী ক্যাডাররা এবং আওয়ামী লীগের অনুগত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সর্বশেষ জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আওয়ামী লীগ নির্মম নির্যাতন, গ্রেফতার এবং যে গণহত্যা করেছে তাতে বিএনপির ৪২২ জন নিহত হয়েছেন।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যারপর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য অপরাধীরা দেশের মধ্যেই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। এইসব অপরাধীদের অল্পসংখ্যক জনসাধারনের হাতে গ্রেপ্তার হলে নির্বিচারে হত্যা না করে আইনের হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে। অথচ আওয়ামী লীগের খোদ সাধারন সম্পাদক বলেছিলেন এভাবে - আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে গেলে একদিনে ১ লাখ নেতাকর্মী হত্যা করা হবে। আওয়ামী লীগের পতনের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের অপরাধে জড়িত অধিকাংশ আত্মগোপনে চলে যায়। এতো গুম, খুন, নির্যাতনের পর ক্ষমতা হারালে আওয়ামী লীগের সঠিক বিচারে যে করুন পরিনতি হবে তা কল্পনা করে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, এমনকি প্রকাশ্যে বক্তব্যেও বলেন- “বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এক রাতেই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন ওবায়দুল কাদের-(২৭ আগস্ট ২০২৩, যুগান্তর)।” বিএনপি, জামায়াত এবং অন্যান্য বিরোধী দল কোনো গণহত্যা তো করেইনি বরং দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নিরাপত্তার জন্য সবাই সোচ্চার ছিলেন।
বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্মম নির্যাতন করলেও বিএনপির তুমুল জনপ্রিয়তা থাকায় নিষিদ্ধ করতে পারেনি। ১৯৭১ সালের গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আদালতের রায়ে নির্বাচন কমিশন ২০১৩ সালে জামায়াত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে। জামায়াতের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের পক্ষের আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। নির্বিচারে, অন্যায়ভাবে এতো নির্যাতন কিংবা নিষিদ্ধ করেও বিএনপি কিংবা জামায়াতের নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের দলীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা যায়নি, বরং সমর্থন এবং জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকের কাছে আওয়ামী লীগ হলো একটি ধর্ম। যে ধর্মের গোড়াপত্তন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এজন্য গ্রামেগঞ্জে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অধিকাংশই দলীয় কোনো সুবিধা, সহযোগিতা কিংবা ভালোবাসা না পেয়েও কেবলমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবেসে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ করেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, জাসদসহ অন্যান্য বিরোধী দল এবং মতের মানুষকে হত্যাযজ্ঞ এবং নির্মম নির্যাতনের পর শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। এই শোককে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করেন যাদের অধিকাংশই ছিল গোঁড়া আওয়ামী লীগ। সময়ের বিবর্তনে এইরকম গোড়াধর্মী সংখ্যা নগণ্য হয়েছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে আওয়ামী লীগ ছিলো লুটপাট, গুম, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, জবরদখল এবং অর্থ পাচারের হাতিয়ার। এই অবৈধ সুযোগ-সুবিধা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন আওয়ামী লীগের অল্প সংখ্যক লোকজন। এই সুবিধাবাদীদের অনেকেই আবার উড়ে এসে জুড়ে বসে, কৌশলে ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে লোপাট করেছেন। গোড়াধর্মী আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীই তেমন কোনো সুবিধা পাননি এই সুবিধাবাদীদের ভীরে। বঞ্চিত আওয়ামী লীগাররাও একটি সময় কায়োমনে চাইতো শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের পতন হোক। নিম্নবিত্ত এবং মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠীর অনেকেই সরকারি বিভিন্ন ভাতা, রেশন সহায়তা কিংবা আওয়ামী লীগের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটিতে নাম লিখিয়েছেন। এদের অনেকেই হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, নির্যাতনের সাথে সম্পৃক্ত নয়। গণহত্যা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে বিচার করা হলে এইসকল নিরাপরাধ মানুষও বিবেচিত হবেন অপরাধী হিসেবে। আওয়ামী লীগ যেভাবে নিরাপদ মানুষকে নির্যাতন করতো অঞ্চলভেদে বিভিন্ন সুবিধাবাদীদের দৌড়াত্বে নির্যাতনের খড়গ নেমে আসবে নিরাপরাধ আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের উপর।
আওয়ামী লীগের এই অপরাধযজ্ঞের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলের শক্তিশালী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী বহির্বিশ্বে দীর্ঘদিন মিথ্যা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে আওয়ামী লীগের অপরাধের বৈধতা দিয়েছে। এখনো তারা সোচ্চার থাকায় সঠিক আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণিত না করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে আন্তর্জাতিক মহলেও এর নেগেটিভ প্রভাব পড়বে।
লেখক: সাবেক গণসংযোগ সম্পাদক, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ। এম.ফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।