
জেলা প্রশাসকদের বিচার বিভাগের ‘সহযোগী’ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
সোমবার সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান।
তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনাদের কাছে আমার আহ্বান, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। বিচার বিভাগের সহযোগী হয়ে কাজ করুন, বাধা সৃষ্টি করবেন না। মনে রাখবেন, শাসন ও ন্যায়বিচার দুটি ভিন্ন পথ নয়, বরং একই গন্তব্যের সমান্তরাল পথ।”
বক্তব্যের শুরুতে তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। ২০২৪ সালের জুলাই ও অগাস্টের ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের শহীদদেরও স্মরণ করেন।
জেলা প্রশাসকরা শাসন, জনসেবা ও ন্যায়বিচারের ‘সংযোগস্থল’ হিসেবে কাজ করেন মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোতে আপনারাই নির্বাহী কর্তৃপক্ষ ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেন, যেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা এবং রাষ্ট্রের মর্যাদা বজায় রাখার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
“জেলা বিচার বিভাগ ও জেলা প্রশাসন– এ দুটি স্তম্ভ পরস্পরের কাছাকাছি অবস্থান করে, যদিও কার্যক্রমে পৃথক, কিন্তু লক্ষ্য অভিন্ন।”
বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ পরস্পরের ‘বিরোধী নয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিচার বিভাগ যেখানে স্বাধীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়, সেখানে জনগণের আইনি ব্যবস্থার প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পায়। আর যেখানে প্রশাসন এই স্বাধীনতাকে সম্মান ও সহায়তা করে, সেখানেই শাসনব্যবস্থা সর্বোচ্চ নৈতিক অবস্থানে পৌঁছায়।
“সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সকল নির্বাহী ও বিচারিক কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হল সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মান্য করা এবং তা বাস্তবায়ন করা। কোনো সরকারি নির্দেশনা, পরিপত্র বা বিজ্ঞপ্তি সুপ্রিম কোর্টের রায়কে বাতিল বা বিলম্বিত করতে পারে না।”
জেলা প্রশাসকরা জেলার আইনগত সহায়তা কমিটিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, কারাগার পরিদর্শন করেন এবং বিচার বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেন, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সহায়ক বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে তিনি জেলা প্রশাসকদের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানান।
বিভিন্ন জেলায় অফিসিয়াল পরিদর্শনকালে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমি জেলা ও বিভাগীয় কমিশনারদের সেবার প্রতি নিষ্ঠা ও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই আমাদের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হতে পারে।”
প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই ‘জনগণের আস্থা’ অর্জন করা সম্ভব এবং বিচারকদের আদেশ দ্রুত বাস্তবায়ন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা এবং সময়োপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে মামলা জট কমানো সম্ভব হবে বলে তিনি মত দেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমাদের ইতিহাসের এই মুহূর্তগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম সাময়িক নয় বরং এটি একটি আজীবন দায়িত্ব, যা আমাদের বিচার বিভাগের প্রধান ভিত্তি গঠন করে।”
জাতি এখন পুরাতন থেকে নতুনের দিকে, অচল অবস্থা থেকে রূপান্তরের দিকে পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মন্তব্য করে বিচারপতি রেফাত আহমেদ বলেন, “আমাদের সামনে এক বিরল সুযোগ রয়েছে, যেখানে একটি জীর্ণ প্রশাসনিক কাঠামোকে পুনর্গঠিত করে একটি গতিশীল ব্যবস্থায় রূপান্তর করা সম্ভব, যেখানে রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ সমান অংশীদার এবং অংশগ্রহণকারী হবে।”
গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর দেওয়া ‘বিচার বিভাগীয় সংস্কার রোডম্যাপ’ বিচার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও জনসেবামুখী করার একটি মৌলিক পদক্ষেপ বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি।
আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, এস এম এমদাদুল হক, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভুঁইয়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।