
চাঁপাইনবাবগঞ্জে সরকারি প্রকল্পের নাম করে মহানন্দা নদী থেকে সেতুর কোল ঘেঁষে অবৈধ বালু-মাটি উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। শেখ হাসিনা সেতুর পাশ চলমান পর্যটন কেন্দ্রে ভরাটের নামে নদী থেকে কোটি কোটি টাকা বালু-মাটি উত্তোলন করছে ভূমিদস্যুরা।
যদিও পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের দাবি, নিয়ম মাফিক নির্ধারিত মূল্য দিয়েই বালু-মাটি কিনছেন তারা। গত কয়েকদিন দিন ও রাতে প্রকাশ্যে অবৈধভাবে এসব বালু-মাটি উত্তোলন হলেও নিরব প্রশাসন।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলছে এই বালু-মাটি উত্তোলনের কাজ। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী থেকে এভাবে বালু-মাটি উত্তোলনকে অবৈধ ও সেতুর জন্য ঝুঁকির কারন হিসেবে উল্লেখ করলেও এনিয়ে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
স্থানীয় বাসিন্দা, বালু-মাটি উত্তোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং অনুসন্ধানে জানা যায়, অবৈধভাবে নদী থেকে বালু-মাটি উত্তোলনের মূলহোতা ভূমিদস্যু আনোয়ারুল ইসলাম সঞ্জু। তিনি বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে যোগসাজশ করে গত কয়েক বছর ধরে পদ্মা ও মহানন্দা নদী থেকে হাজার হাজার টন বালু ও মাটি উত্তোলন করেছেন। ভূমিদস্যু আনোয়ারুল ইসলাম সঞ্জু জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক পৌর মেয়র মোখলেসুর রহমানের অত্যান্ত ঘনিষ্ঠ ও তার বালু-মাটি সিন্ডিকেটের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র মোখলেসুর রহমানের প্রশয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে জেলার বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে বিনা বাধায় বালু ও মাটি উত্তোলন করেছে সঞ্জু। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আনোয়ারুল ইসলাম সঞ্জুর দাবি, এনিয়ে তিনি আতাত করেছেন বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজন নেতার সাথে। তিনি জানান, রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এসব করতে হচ্ছে। এর আগে মহানন্দা নদীতে বালু উত্তোলনে দফায় দফায় বাধা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেক কষ্টে সব ম্যানেজ করে এখন তা চালু করা হয়েছে।
সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের পোড়াগাঁ এলাকায় মহানন্দা নদীতে বালু উত্তোলনের পর ট্রাক্টরে নিয়ে যাওয়া এক ট্রাক্টর চালক বলেন, কয়েকদিন আগে ইউএনও ম্যাডাম এসে নদী থেকে বালু-মাটি উত্তোলন বন্ধ করে গেছিল। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর তা আবার চালু হয়েছে।
জমির মালিক রাইহান আলী জানান, জায়গাগুলো নদীর হলেও আমাদের নামে রেকর্ডীয়। জমি চাষাবাদের সুবিধার জন্য বালু-মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। এরপর তা সরকারি প্রকল্প পর্যটন এলাকায় দেয়া হচ্ছে। তবে নদী থেকে এভাবে বালু-মাটি উত্তোলনের কোন অনুমতি আছে কি না, এবিষয়ে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
পর্যটন এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মো. তারিফ জানান, সঞ্জু নামের ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা এসব বালু কিনে নেয়। তিনি কোথা থেকে বা কিভাবে বালু-মাটি দিচ্ছে তা আমাদের জানা নেই। এনিয়ে তার সাথেই কথা বলেন।
স্থানীয় বাসিন্দা তারেক হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে একপ্রকার জোর করেই নদী থেকে বালু-মাটি উত্তোলন করে পর্যটন কেন্দ্রে দেয়া হয়েছে। সাবেক মেয়র মোখলেসুর রহমান ও জেলা আ.লীগ-ছাত্রলীগ ও কৃষকলীগের কিছু নেতা এর নেতৃত্ব দিয়েছে। আর এসব কর্মকান্ড মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করেছেন ভূমিদস্যু আনোয়ারুল ইসলাম সঞ্জু। কিন্তু এসব বালু-মাটি ভরাটের জন্য তো আলাদা বরাদ্দ পেয়েছেন ঠিকাদার। তাহলে এভাবে নদী থেকে কেন নিতে হবে?
স্থানীয় কৃষক শফিকুল ইসলাম জানান, দ্বিতীয় মহানন্দা সেতুর (শেখ হাসিনা সেতু) এতো কাছাকাছি নদীর মধ্য থেকে দিন-রাত সমানহারে বালু-মাটি উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছে ভূমিদস্যুরা। কিন্তু প্রশাসন যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অবৈধভাবে এসব বালু-মাটি উত্তোলনের কারনে সেতুর পাশাপাশি ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে নদীর দুই পাড়ে থাকা হাজার হাজার বিঘা ফসলী জমি। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে শত শত কোটি টাকার সম্পদ নদীতে তলিয়ে যাবে।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম বলে, আনোয়ারুল ইসলাম সঞ্জু আগে থেকেই বালু-মাটি উত্তোলন করেছে, এখনও করছে। অবৈধভাবে বালু-মাটি উত্তোলনের সাথে জেলা বিএনপি বা বিএনপির কোন নেতাকর্মীর কোন ধরনের সম্পর্ক নেই। বিএনপির নাম করে সে (আনোয়ারুল ইসলাম সঞ্জু) যদি এসব অবৈধ কর্মকান্ড করে, তাহলে তাকে পুলিশে দেয়ার অনুরোধ করছি সকলের প্রতি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা জামায়াতের এক শীর্ষ নেতা জানান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এর সহযোগী সংগঠনের কেউই কখনোই দেশের যেকোন সম্পদের ক্ষতি হয়, এমন কাজে সম্পৃক্ত নয়। এসব অবৈধ বালু-মাটি উত্তোলনে আমাদের দলের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণের কোন প্রশ্নই আসে না। কেউ যদি দলের নাম করে এমন কাজ করে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট। পাশাপাশি আমাদের দলের কোন নেতাকর্মী এর সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগাঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম আহসান হাবীব ভোরের পাতাকে বলেন, মহানন্দা নদীর কোন পয়েন্ট থেকে বালু-মাটি উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হয়নি। অবৈধভাবে বালু-মাটি উত্তোলন করলে জেলা প্রশাসনকে এবিষয়ে অবহিত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের পাতাকে জানান, নদীর পাশে চলমান পর্যটন কেন্দ্র ভরাট কার্যক্রম অবশ্যই নিয়ম মেনে করতে হবে। অবৈধভাবে বালু-মাটি ভরাট করলে যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. তাছমিনা খাতুন বলেন, সেতুর কাছাকাছি নদী থেকে এভাবে বালু-মাটি উত্তোলনের কোন অনুমতি দেয়া হয়নি। অবৈধ বালু-মাটি উত্তোলনের বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে৷