প্রাথমিকে বৃত্তির বাইরে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরা: শিক্ষা কি তবে বৈষম্যের শিকার?

দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাংলাদেশ সরকার পুনরায় প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা এ বছর থেকে ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষার পর পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হবে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ট্যালেন্টপুল ও সাধারণ বৃত্তির পরিমাণ এবং বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে, এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের কিন্ডারগার্টেনে অধ্যয়নরত কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। প্রাথমিক শিক্ষা জীবন একটি শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ার ভিত্তিপ্রস্তর। সেই ভিত্তিকে দৃঢ় করতে সরকার পরিচালিত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা মেধাবী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করে এবং তাদের মাঝে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থী এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না কেবল একটি ব্যবস্থাগত বৈষম্যের কারণে। তারা হয়তো মেধায় পিছিয়ে নয়, বরং পেছনে পড়ে আছে নীতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে। প্রশ্ন জাগে শিক্ষার এই প্রাথমিক স্তরে কেন থাকবে এমন বৈষম্য? কেন একটি বৃহৎ শিক্ষার্থী জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও উৎসাহ থেকে বঞ্চিত হবে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের ধরন অনুযায়ী?
প্রাথমিক শিক্ষা জীবন একটি শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ার ভিত্তিপ্রস্তর। বৃত্তি পরীক্ষা যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন ব্যবস্থা, তেমনি এটি শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গঠনের হাতিয়ার। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরা সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারায় তাদের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই এক অনাকাক্সিক্ষত বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এটা দুঃখজনক যে, এই শিক্ষার্থীরা মেধায় বা প্রস্তুতিতে নয়, বরং শুধুমাত্র ব্যবস্থাগত কারণে পিছিয়ে পড়ছে। সরকার পরিচালিত ও সরকার-অনুমোদিত স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য যেই বৃত্তি পরীক্ষা, তা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের জন্য ‘নিষিদ্ধ’ এই অবস্থান ন্যায়ের পরিপন্থী।
বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হয় এবং এটি প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৪০,০০০ কিন্ডারগার্টেন রয়েছে, যেখানে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। এই কিন্ডারগার্টেনগুলোতে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে, যারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। তবে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনেকেই সরকারি নিবন্ধন বা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি ছাড়াই পরিচালিত হয়, যা তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার একটি প্রধান কারণ।
কিন্ডারগার্টেনগুলো প্রায়ই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় উন্নত পাঠদান পদ্ধতি এবং শিক্ষার পরিবেশ প্রদান করে। অনেক কিন্ডারগার্টেন আধুনিক শিক্ষণ কৌশল, ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান, কম্পিউটার শিক্ষা, এবং সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশে গুরুত্ব দেয়। অভিভাবকদের মধ্যে ধারণা রয়েছে যে, কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষার মান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে উন্নত, যার কারণে তারা তাদের সন্তানদের এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান। এই উন্নত শিক্ষার মান সত্ত্বেও, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া তাদের মেধা ও সম্ভাবনার প্রতি অবিচার।
সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে, কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার মান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো একই মানদ-ে পৌঁছায় না। ২০১৯ সালে সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন জানিয়েছিলেন যে, সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত করা হবে, যাতে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীরা সরকারি বিদ্যালয়ে আকৃষ্ট হয়। তবে, এই ধারণা কিন্ডারগার্টেনের উন্নত শিক্ষণ পদ্ধতি এবং অবকাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যা অনেক ক্ষেত্রে সরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে এগিয়ে।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন দেশের কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসোসিয়েশনটি কিন্ডারগার্টেনের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, এবং শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য সরকারের সাথে নিয়মিত সংলাপে অংশ নেয়। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এসোসিয়েশন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা যুক্তি দেখিয়েছে যে, কিন্ডারগার্টেনগুলো দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এখানে পড়া শিক্ষার্থীরা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতোই মেধাবী।
এসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান সরকার এই বিষয়ে বলেছেন, “কিন্ডারগার্টেনে পড়া শিক্ষার্থীরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের বৃত্তি পরীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা শিক্ষার সমতা ও সমান সুযোগ নীতির পরিপন্থী। আমরা দীর্ঘদিন ধরে কিন্ডারগার্টেনের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করার দাবি জানিয়ে আসছি। সরকার যদি নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করে এবং জাতীয় শিক্ষাক্রমের সাথে সমন্বয় সাধনের সুযোগ দেয়, তাহলে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরাও বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। এটি শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের আস্থা বাড়াবে।” তিনি আরও জানান, এসোসিয়েশন এই বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও ভাবছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার যে পরিপত্র জারী করেছে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন সারা বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেন এবং এর শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে “কেন কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বৃত্তিতে অংশ নিতে পারবে না?” তার জন্য হাইকোর্টে একটি রীট করেছে। মহামন্য হাইকোর্ট ইতোমধ্যে রায় দিয়েছে, “কেন কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বৃত্তিতে অংশ নিতে পারবে না? তা দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতকে জানাতে হবে। এতে প্রতিয়মান হয় যে, হাইকোর্ট ও চাচ্ছে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরা বৃত্তিতে অংশগ্রহণ করুক। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে জানা যাবে প্রাথমিক বৃত্তিতে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারবে কী না?
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরা কি এ দেশের শিক্ষার্থী নয়?
কিন্ডারগার্টেনে পড়া শিক্ষার্থীরা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের নাগরিক এবং এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অংশ। তবে, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও কাঠামোগত অবস্থানের কারণে তারা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা একমুখী এবং সবার জন্য বাধ্যতামূলক হবে। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনগুলোর বৈচিত্র্যময় পাঠ্যক্রম এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাব এই একমুখী শিক্ষার লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে।
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ার ফলে বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে:
সরকারি ও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষাগত সুযোগের বৈষম্য বাড়বে, যা সামাজিক অসমতাকে উসকে দিতে পারে। অনেক অভিভাবক কিন্ডারগার্টেনে সন্তান ভর্তি করানোর পর তাদের বৃত্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় হতাশ হবেন।
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে কিন্ডারগার্টেন বা কেজি স্কুল। এসব স্কুলে শহর ও গ্রামীণ সব অঞ্চলের হাজারো শিশু নিয়মিত শিক্ষা নিচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, জাতীয়ভাবে আয়োজিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়, বিশেষত বৃত্তি পরীক্ষায়, এই শিক্ষার্থীরা আজও পিছিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে। প্রশ্ন জাগে একই বয়সের, একই স্তরের, একই জাতির শিক্ষার্থী হয়েও কেন একজন সরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্র বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সম্মানিত হবে, আর পাশের কেজি স্কুলের শিক্ষার্থী শুধু প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি না থাকার কারণে সেই সুযোগ হারাবে?
শিশু তো সকলের তবে বৈষম্য কেন?
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা কারা? তারা তো এই দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্ডারগার্টেন হোক আর সরকারি বিদ্যালয় সব শিক্ষার্থীই এই দেশেরই সন্তান। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার প্রতিটি শিশুকে সমান অধিকার ও সুযোগ দেওয়ার। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই “অবৈধ” বা “অযোগ্য” নয়। তারা হয়তো ভিন্ন ধাঁচের প্রতিষ্ঠানে পড়ছে, কিন্তু তাদের শিক্ষা, মেধা ও স্বপ্নের মূল্য কি কম?
প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা পুনরায় চালু করা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা শিক্ষার সমতার নীতির পরিপন্থী। প্রায় ৪০,০০০ কিন্ডারগার্টেনে পড়া লক্ষাধিক শিক্ষার্থী দেশের নাগরিক হিসেবে সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকারী। কিন্ডারগার্টেনগুলোর উন্নত পাঠদান পদ্ধতি এবং শিক্ষার মান সত্ত্বেও তাদের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া অন্যায্য। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন, বিশেষ করে মহাসচিব মিজানুর রহমান সরকারের নেতৃত্বে, এই বৈষম্য দূর করতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। সরকারের উচিত কিন্ডারগার্টেনগুলোকে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সমন্বিত করে তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি পরীক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করা। এতে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে এবং সকল শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে।
শিক্ষা শুধু শিখন নয়, এটি ন্যায়ের প্রতীক। আর সেই ন্যায়ের ভিত্তিতে সব শিশুর জন্য সমান সুযোগ থাকা উচিত। কিন্ডারগার্টেনের শিশুরাও এই দেশেরই ভবিষ্যৎ তারা কেন বঞ্চিত থাকবে কেবল প্রতিষ্ঠানগত কাঠামোর কারণে?
সরকার যদি সত্যিই শিক্ষার মানোন্নয়ন ও সমতা নিশ্চিত করতে চায়, তবে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে, পাঠ্যক্রমে সামঞ্জস্য আনতে হবে, এবং এসোসিয়েশনের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে।
শিক্ষার শুরুতেই যদি বৈষম্য শুরু হয়, তবে সেই শিক্ষা কতটা সমতাভিত্তিক হতে পারে? কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের সুযোগ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হবে বাংলাদেশ শিক্ষা, ন্যায় এবং সমতার পথেই এগোচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট।