
বৈশ্বিক মহামারির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কারনে ক্ষতিগ্রন্থ অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে সামনে রেখে রাজস্ব প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের লক্ষ্য এবং উন্নয়নশীল দেশে উত্তরনের প্রস্তুতি গ্রহন, নতুন কর্মসংস্থান সৃস্টি ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, স্থানীয় শিল্পের বিকাশ, প্রতিরক্ষন ও বানিজ্য সহজিকরনের মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রপ্তানীমুখী ও ভারি শিল্পের বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার (এমপি) দূরদর্শী দিকনির্দেশনা ও বিচক্ষন প্রয়াসে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) এর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
বাজেটে শিক্ষা ও দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, অবকাঠামো ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এগুলো বাজেটের ইতিবাচক দিক।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসায় আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান খাত, রপ্তানীখাতের প্রস্তাবনার প্রতিফলন প্রস্তাবিত বাজেটে পাওয়া যায়নি।
প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃস্টির জন্য সহায়ক হবে না বলে মনে করছি-
স্টিল বিল্ডিং তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরণের নির্মান সামগ্রীর উপর আমদানি শুল্ক ৫% থেকে বাড়িয়ে ১০% নির্ধারণ করার প্রস্তাব।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মূলধনী যন্ত্রাংশ ও নির্মাণ সামগ্রীর আমদানি শুল্ক ০% থেকে ১% নির্ধারণ।
* জ্বালানী সাশ্রয়ী বাতির উপর ভ্যাট ৫% থেকে বাড়িয়ে ১৫% এর প্রস্তাব।
* নতুন বন্ড লাইসেন্স ফি ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ) হাজার টাকার স্থলে ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) টাকা এবং লাইসেন্স নবায়ন ফি বার্ষিক ৫,০০০/- (পাঁচ) হাজার টাকার স্থলে ১০,০০০/- (দশ হাজার) টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব।
আমরা মনে করি, শিল্প টিকে থাকলে রাজস্ব আসবে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃস্টি হবে। গত অর্থবছরে আমাদের পোশাক রপ্তানি ছিলো ৪৭ বিলিয়ন ডলার, ২০৩০ সাল নাগাদ আমরা ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছি। সরকারের অব্যাহত সহযোগিতায় আমরা রপ্তানি বাড়াতে পারলে কর হার না বাড়িয়েও রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব। এতে করে অর্থনীতি বেশি উপকৃত হবে।
আমরা সরকারের নিকট বারবার জোর দাবী জানিয়ে আসছি যে, ২০২৯ সাল পর্যন্ত পোশাক ও বস্ত্র খাতের চলমান সকল নীতিসহায়তা অব্যাহত রাখা এবং বিকল্প নীতিসহায়তা প্রবর্তন না করা পর্যন্ত যেন চলমান নীতিসহায়তাগুলো কাটছাট না করা হয়।
বাজেটে রপ্তানী খাত শিল্পের জন্য নিম্নলিখিত সহায়ক কিছু নীতি সহায়তার ব্যবস্থা রাখার জন্য প্রস্তাব করছি:
উৎসে কর ০.৫% এ নামিয়ে আনা এবং এটিকে চূড়ান্ত করদায় হিসেবে গণ্য করা এবং আগামী ৫ বছর পর্যন্ত অব্যাহত রাখা।
রপ্তানী খাতে নীতি সহায়তার উপর আয়কর অব্যাহতি
শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য ও সেবার উপর ভ্যাট ও পরোক্ষ ট্যাক্স প্রত্যাহার করতে হবে।
২০২৬ এ LDC উত্তরণের পর বিকল্প সহায়তার ব্যাবস্থা করা।
HS Code ও ওজন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা,
ERQ এর উপর আয়কর ২০% থেকে কমিয়ে ১০% করা,
অগ্নি ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে আমদানির উপর কর রেয়াত,
পোশাক শিল্পের ঝুট বা বর্জ্য সংগ্রহের উপর ৭.৫% ভ্যাট প্রত্যাহার করা
রিসাইকেল ফাইবার সরবরাহের উপর ১৫% ভ্যাট প্রত্যাহার করা
কাস্টমস আইন ২০২৩ এর ১৭১ ধারায় আমদানিকৃত পণ্যের এইচ এস কোড ভুল হলে ২০০%-
৪০০% জরিমানার বিধান প্রত্যাহার করা
পরিবেশবান্ধব কারখানার অন্যতম উপাদান সোলার প্যানেল আমদানিতে শুল্কহার শুন্য (০%) করা।
* ব্যাংক সুদের উৎসে করহার কোম্পানি করদাতার জন্য বাজেটে প্রস্তাবিত ২০ শতাংশ করা হয়েছে যা পূর্বের ন্যায় ১০ শতাংশ রাখার প্রস্তাব করছি।
* এক্সিট পলিসি এবং এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি সুবিধা প্রবর্তন করা।
নন-কটন টেক্সটাইলে বিশেষ নীতি সহায়তা বরাদ্দ রাখা।
রপ্তানীখাতসহ সকল শ্রমিকদের জন্য ফুড রেশনিং বাবদ বরাদ্দ রাখা।
* অগ্নি ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম আমদানির উপর কর রেয়াত সুবিধা দেয়া।
ব্যবসা সহজীকরণ- বিশেষ করে NBR, VAT, Customs & Bank সংক্রান্ত জটিলতা কমানো ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে
* ব্যাংক সুদ সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।
* রপ্তানীমুখী শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকী দিতে হবে।
নীতিসহায়তার আওতা বাড়াতে হবে। পোর্ট চার্জ কমাতে হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পগুলোকে বিশেষ নীতি সহায়তা ও অর্থায়ন সুবিধার আওতায় আনা।
নতুন বাজার ও নতুন পণ্য উৎসাহিত করতে নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখা।
* ম্যান-মেইড ফাইবার ভিত্তিক শিল্পে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ নীতি সহায়তার ব্যবস্থা করা বা আনা।
মাংস প্রক্রিয়াজাত এবং রপ্তানি প্রসারের জন্য সুপারিশমালাঃ
ক) মাংস রপ্তানিতে ফ্রিজার ভ্যান এবং চিলার ভ্যান অপরিহার্য বিধায় এগুলিকে আমদানীর ক্ষেত্রে
মূলধনী পণ্য হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে শুল্ক অব্যাহতি দিয়ে মাংস রপ্তানীতে বিশ্ববাজারে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করার জন্য আবেদন করছি।
খ) Further Processed Meat (সসেজ, পেপারনি, সালামি ইত্যাদি) একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত যেখানে উপকরন হিসাবে বিভিন্ন ধরনের মসলা এবং প্যাকেজিং পণ্য আমদানি নির্ভর বিধায় উপরোক্ত উপকরন আমদানিতে শুল্ক সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাচ্ছি।
হিমায়তি ও নন হিমায়িত পণ্য রপ্তানি:
হিমায়িত চিংড়িতে ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা প্রদান। একই সঙ্গে হিমায়িত মাছ রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ৫ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করা।
* বিশ্ববাজারে আমাদের দেশে উৎপাদিত বাগদা চিংড়ির চাহিদা যতটুকু ছিল, তাও সাম্প্রতিক সময়ে কমে গেছে। এর কারণ অর্থনৈতিক অস্থিরতা। বর্তমানে চিংড়ির উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দাম অফার করছেন বিদেশি ক্রেতারা। ফলে রপ্তানি টিকিয়ে রাখতে হলে উৎপাদন খরচ কমানোর কোনো বিকল্প নাই। সে মোতাবেক উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে এবং নগদ সহায়তার ওপর ১০ শতাংশ অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করেছি।
* কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রপ্তানির সহজিকরনের লক্ষ্যে মাছ আহরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে রপ্তানির বিভিন্ন অসুবিধা দূরীকরণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য অধিদপ্তরের আন্তরিক সহায়তাসহ এ খাতের রপ্তানিকারকদের জন্য এয়ারপোর্টের কাছাকাছি একটি কার্গো জোন প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দের জোর সুপারিশ করছি।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য:
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য; পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কৃষিজাত পণ্য এই তিনটি খাতকে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত করে এই খাতের বিকাশে নীতি সহায়তা দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
জাতীয় অর্থনীতিতে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা (জুতা) শিল্প একটি রপ্তানিমুখী শ্রমঘন খাত। বর্তমানে রপ্তানি বাণিজ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয় আসে এ খাত থেকে। তবে সম্ভাবনাময় খাতটি বর্তমানে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে এবং রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন শুল্ক-অশুল্ক বাধা এবং অন্যান্য রপ্তানি খাতের সঙ্গে বিদ্যমান অসামঞ্জস্য দূর করা প্রয়োজন।
* চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বন্ডসুবিধাভেদে ভিন্ন ভিন্ন কর হার রয়েছে। ফলে নতুন কিংবা ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখান থেকে কর সুবিধা নিতে পারে না। এ জন্য রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত সব ধরনের শিল্প কাঁচামালের জন্য সমহারে মোট ১ শতাংশ করে আমদানি কর নির্ধারণ করা।
* দেশে চামড়ার জুতা এবং সিনথেটিক ও ফেব্রিকসের তৈরি জুতার জন্য প্রয়োজনীয় পশ্চাৎ সংযোগশিল্প তৈরি হয়নি। এ ছাড়া ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সাধারণ বন্ডেড ওয়্যার হাউস স্থাপন ও অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম আমদানিতে শুল্ক হার কমানোর দাবী করছি। ADESH
রাসায়নিকে ভ্যাট কমানোর দাবি
বর্তমানে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অপরিহার্য রাসায়নিক আমদানির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে। এই হার কমিয়ে সাড়ে ৭.৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি। ভ্যাট কমালে চামড়া রপ্তানি বাড়বে এবং অবৈধ পথে রাসায়নিক আমদানি কমবে।
এ ছাড়া চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) জন্য রাসায়নিক ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
বাইসাইকেল রপ্তানী:
ওয়ার্লড ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ ইউরোপ প্রতিবছর রপ্তানীকারক দেশগুলি থেকে ৩ কোটি সাইকেল আমাদানী করবে। ইউরোপের আমদানী লক্ষমাত্রা ধরতে হলে বাইসাইকেলের কাচামাল আমদানী সহজীকরন করতে হবে এবং দেশীয় কাচামাল উৎপাদনে নীতি সহায়তা প্রদান করতে হবে, তাহলেই বাইসাইকেল রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাইসাইকেল খাত ৩য় রপ্তানি খাত হিসেবে আবির্ভূত হবে।
জ্বালানীখাতের স্থিতিশীলতা:
শিল্প ও অর্থনীতির স্বার্থে জ্বালানীর দাম স্থিতিশীল ও সহনীয় রাখতে হবে:
বিগত ৫ বছরে গ্যাসের মূল্য বেড়েছে ২৮৬.৫% ডিজেলের মূল্য বেড়েছে ৬৮% বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে ৩৩.৫০%, আর এসবের কারনে পরিবহন খরচও বেড়েছে। দাম বাড়ানোর পরও জ্বালানী সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়। এভাবে দফায় দফায় জ্বালানীর দাম বাড়ানোর কারনে উৎপাদন খরচও বেড়েছে গড়ে ৫০%।
শিল্পাঞ্চলের বাইরে নতুন কোনে কারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে না বলে যে সিদ্ধান্ত নেয়া
হয়েছে তা আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত।
শিল্প ও অর্থনীতির স্বার্থে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে হবে।
*শিল্পের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কোয়ালিটি এবং কম্পিটিটিভ দামে গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ প্রয়োজন।