বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে টানাপোড়েন
বিএনপি নেতাদের অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সে সময় জামায়াত কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বা কোন প্রতিবাদ করেনি।
সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে তখন থেকেই বিএনপির তৃণমূলে জামায়াত নিয়ে একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি হতে থাকে।
দলটির নেতারা আরও বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিএনপি যে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছিল, সেই থেকে লম্বা সময় ধরে দলটির সব পর্যায়ের নেতা কর্মীদের মধ্যে হতাশা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতকে বিএনপি সেভাবে পাশে পায়নি। বরং জামায়তের অনেক কর্মকাণ্ডের দায় বিএনপিকে বহন করতে হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
বিএনপি নেতাদের অনেকে বলেছেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে তাদের ২০ দলীয় জোট ব্যর্থ হয়। কিন্তু সে সময় এবং পরের বছর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতেও সারাদেশে তাদের কর্মসূচি যে সহিংস রূপ নিয়েছিল, দেশে এবং বিদেশে, তার পুরো দায় বিএনপির ওপরই এসেছে।
ফলে সেই ২০১৫ সাল থেকেই মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের সাথে বিএনপির নেতা কর্মীদের সম্পর্কের টানাপোড়েন চরমে পৌঁছায়।
বিএনপির নেতৃত্বও দলের হতাশা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য জামায়াতকে বাদ দিয়ে নিজেরা দলীয়ভাবে কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করে।
দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, জেলা- উপজেলা পর্যায়ে বা তৃণমূল স্তরে বিএনপির নেতা কর্মীদের এখনও জামায়াতের সাথে কোন যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে এখনও জামায়াতের প্রভাব রয়েছে বলে তারা মনে করেন।
তবে বিএনপির তৃণমূল থেকেই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য দলটির নেতৃত্বের ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছে।
দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্ব সারাদেশের নেতা কর্মীদের মতামত নিয়েছিল। সে সময় সারাদেশ থেকেই তাদের তৃণমূল স্তরের নেতাকর্মীরা জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার সুপারিশ করেছিলেন।
সেই প্রেক্ষাপটে ২০ দলীয় জোটের বাইরে বিএনপি ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের আলাদা একটি জোট গঠন করেছিল।
যদিও শেষপর্যন্ত নিবন্ধন না থাকার কারণে জামায়াতের প্রার্থীরা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই সেই নির্বাচনে অংশ নেয়।
সঙ্গ ছাড়ার আলোচনার প্রেক্ষাপট
২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠন করে।
সেসময় বিএনপির সেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের জোটের ব্যর্থতার প্রশ্ন ওঠে।
সেই প্রেক্ষাপটে বিএনপিতে হতাশা বেড়ে যায়।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, হতাশা এবং বিপর্যস্ত পরিস্থিতি কাটিয়ে তাদের দল সামনে কীভাবে এগুতে পারে, সে ব্যাপারে সুপারিশ বা প্রস্তাব তৈরির জন্য স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি গত বছরের প্রতিবেদন দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পেশ করেন।
সেই প্রতিবেদনে জামায়াতের সাথে জোটগত সম্পর্ক না রাখার প্রস্তাব করে তার স্বপক্ষে কারণ এবং যুক্তিও তুলে ধরা হয়।
আর এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই জামায়াত ইস্যুটি আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় আসে বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরামে। এখন সেই আলোচনাই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
সঙ্গ ছাড়ার পক্ষে যুক্তি
বিএনপি নীতি নির্ধারকদের মধ্যে যারা জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাবকে বড় বিষয় হিসাবে দেখছেন বলে মনে হয়েছে।
দলটির এমন একজন নেতা জানিয়েছেন, সেই ২০১৪ সাল থেকেই তারা যখন ঢাকায় পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের সাথে কথা বলতে গেছেন, তখন জামায়াতের সাথে জোটের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব তারা উপলব্ধি করেছেন। ফলে এই বিষয়টিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
জামায়াতসহ কয়েকটি দলকে নিয়ে বিএনপি চার দলীয় জোট গঠন করেছিল সেই ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রথম দফার সরকারের সময়ে। সেই জোটই পরে ২০ দলীয় জোটে রূপ পেয়েছে।
বিএনপির নেতারা বলেছেন, বিএনপি যখন জামায়াতকে নিয়ে জোট গঠন করেছিল, তখন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর একটা প্রভাব তৈরির টার্গেট তাদের ছিল।
তারা আরও বলেছেন, সে সময় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর জামায়াতের প্রভাব ছিল। এই চিন্তা থেকে জামায়াতকে সাথে রাখার জন্য বিএনপিরই জোর চেষ্টা ছিল।
কিন্তু পরে কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উত্থানের প্রেক্ষাপটে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতিতেও অনেক মেরুকরণ হয়েছে। সেখানে একক কোন ইসলামপন্থী দলের প্রভাব কমেছে বলেও বিএনপি নেতারা মনে করেন।
এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের র্শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি বা সাজা হয়েছে।
তারা এই বিষয়গুলো এখন বিবেচনায় আনছেন জামায়াতের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রশ্নে।
সম্পর্ক রাখার বিপক্ষে যুক্তি
বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে যারা জামায়াতের সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে চাইছেন, তারা ভোটের হিসাব নিকাশকেই এখনও গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তাদের একজন বলেছেন, বিএনপি কেন জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ছে না- এসব প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকেই নানা প্রপাগাণ্ডা বা প্রচারণা চালানো হয় বলে তারা মনে করেন। সেজন্য তারা মনে করেন জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সরকারের ফাঁদেই পা দেয়া হবে।
এটিই তাদের বড় যুক্তি। একইসাথে বিএনপির এই নেতারা মনে করেন, জামায়াতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক প্রায় দুই যুগের। ফলে ভোটের রাজনীতিতে এই সম্পর্কের প্রয়োজন আছে।
বিএনপি নেতারা এটাও বলেছেন, আলোচনার পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি যাই আসুক, তারা যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এতদিনের মিত্র জামায়াতের এখনকার নেতৃত্বের সাথেও আলোচনা করতে চান।
তারা মনে করেন, এবার যেহেতু নীতি নির্ধারকরা আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করছেন, ফলে তাদের একটা পরিস্কার অবস্থান তুলে ধরতে হবে।
তবে এই আলোচনার সমাপ্তি কবে হতে পারে বা কখন কোন সিদ্ধান্ত আসতে পারে- সে ব্যাপারে বিএনপি নেতৃত্ব সুনির্দিষ্টভাবে কোন সময়ের কথা উল্লেখ করছে না।
ভোরের পাতা/ই