ড. কাজী এরতেজা হাসান
দেশের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। তবে এটা সত্য যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে এসেছেন। গ্রামীণ মানুষের দোড়গোড়ায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা তার বড় একটি স্বপ্ন এবং এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি বসে নেই। বেশ কয়েক বছর আগেই গ্রামীণ মানুষের দোড়গোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন কমিউনিটি ক্লিনিক। কয়েক হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রান্তিক মানুষের যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে তা উল্লেখ করার মতো। তারপরও যে কথাটি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা কতটা সুলভ হয়েছে? এটা নিয়ে আবার কথা বলবো, তবে আওয়ামী লীগ এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে ১১টি বিষয়ে যে অগ্রধিকার দিয়েছে তার মধ্যে সপ্তমটি হলো- 'নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা।' নির্বাচনি ইশতেহারে এটির অগ্রধিকার দেওয়ার যে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে তা সবাইকে বুঝতে কষ্ট হবেনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি স্তরের ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। এই পরিবর্তনের লক্ষ্যই ছিল উন্নত বাংলাদেশ, মানুষের জীবনযাত্রার মান বদলে দেওয়া। দেশের দুঃখি মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, অর্থনৈতিক মুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া মানুষ ভালো থাকতে পারে না। তার স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় না। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ হয় অর্থনৈতিক মুক্তির মধ্যদিয়ে। তাই তিনি দেশের প্রত্যেকটি স্তরে বদলে দেওয়ার অভিযাত্রায় আত্মনিয়োগ করেন। মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াটা একটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। প্রত্যেক বছরে যে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়, তাতে নানা খাতে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তারমধ্যে স্বাস্থ্যখাতে
উল্লেখযোগ্য অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে সরকার। কিন্তু এ ব্যাপারে খোলামনে যদি কিছু কথা বলি, তাহলে দেখা যাবে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে অভিযোগের বাস্তবসম্মত কারণ আছে। সরকার চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যের জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে, সেই অর্থের বিপরীতে মানুষ কতটা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে তা নিয়ে সহস্র প্রশ্ন উঠতে পারে এবং উঠেও থাকে। সবারই মনে থাকার কথা যে, একটা সময় চিকিৎসকরা হাসাপাতালে গরহাজির থাকতেন। জেলা ও থানা পর্যায়ে চিকিৎসকরা সরকারি হাসাপাতালে উপস্থিত না থাকার রেকর্ড গড়ে ছিল। ফলে প্রান্তিক মানুষ স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হতেন। এখন এটার যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। সরকার হাসপাতালে চিকিৎসকদের হাজির থাকার বিষয়ে কড়াকাড়ি আরোপ করায় চিকিৎসকরা চাকরি ঝুঁকি না নিয়ে ঠিকঠাকমতো হাসপাতালে উপস্থিত থাকেন। রাজধানীর সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের পেশাদারিত্বের প্রতি যতটা যত্নশীল, মফস্বল শহরের সরকারি হাসাপাতালে এটা এখনও কম রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করার যে অঙ্গিকার করেছে তা আশা করা যায় আওয়ামী লীগ নতুনভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে এটি বাস্তবায়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষের উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য বিশাল কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ ইতিমধ্যেই নিতে শুরু করেছে। তারমধ্যে বিশেষভাবে বলা চলে বিভাগীয় শহরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসাপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। কয়টি বিভাগীয় শহরে নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে যে কাজটি হবে তাহলো চিকিৎসকরা চিকিৎসায় গবেষণা ও চিকিৎসা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে পারবেন; যা নিতে বিদেশে যেতে হতো। এখন আর এর খুব একটা প্রয়োজন পড়বে না। বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক-প্রধানমন্ত্রী ইতিপূর্বেই ঘোষণা করেছেন, ফের ক্ষসতায় এলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রোগীর ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি
আশা করি বাস্তবায়িত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে। আমরা জানি, তিনি মানুষকে। মানুষকে যে কথা দেন সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গিকার তিনি কখনোই ভঙ্গ করেন না। নির্বাচনি ইশতেহারে যেহেতু নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা হবে এই প্রতিশ্রতি তিনি দিয়েছেন, অবশ্যই নিম্ন আয়ের মানুষের উন্নত ও ভালো স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করে তুলবেন। নিম্ন আয়ের মানুষ তারা খেটে খাওয়া মানুষ, তাদের চিকিৎসা ব্যয় মেটানো অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে। দেশে সরকারি হাসাপাতালের পাশাপাশি বহু বেসরকারি হাসাপাতাল গড়ে উঠেছে। রাজধানীসহ প্রতিটি মফস্বল শহরে বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসাপাতাল গড়ে উঠেছে। এসব বেসরকারি ক্লিনিকে রোগীরা প্রায় প্রতারিত হন। বেশিমাত্রায় চিকিৎসা খরচ নেওয়া হয়। এতে সাধারণ রোগীদের বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগের বিষয়টি সকলের জানা। তাই যদি সরকারি হাসাপাতালে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সুলভ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় তাহলে বেসরকারি হাসাপাতালে বেপরোয়া আচরণ বন্ধ হবে। দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রতিযোগ প্রতিষ্ঠিত যে, সরকারি হাসাপাতালের চিকিৎসকরা নিজ কর্মস্থলে রোগী দেখায় মনোযোগী নন। আন্তরিকভাবে রোগী দেখায় যতটা সময় দেওয়া উচিত তা তারা করেন না। কিন্তু বেসরকারি ক্লিনিকে বসে রোগী দেখায় সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখান। এমনও শোনা যায় যে, সরকারি চিকিৎসকেরা মিলে বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসাপাতাল তৈরি করে রোগী নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। বহু বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসাপাতাল আছে যা সনদ না নিয়ে চলছে। অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এসব অবৈধ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে দেখা যায়। উন্নত বিশ্বের মানুষ কতটা উন্নত স্বাস্থ্যসেবায় পান, তার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ কতটা স্বাস্থ্যসেবা পায় তা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করে কোনও লাভ নেই, অন্তত এখন এ বিষয়ে কথা বলার সময় আসেনি। কিন্তু এটা বলা যায় যে, কেন আমরা উন্নত দেশের মতো স্বাস্থ্যসেবা পাবো না। আমাদের সরকার তো স্বাস্থ্যখাতে কম অর্থ বরাদ্দ দেন না। তাহলে ঘাটতি কোথায়? এ ব্যাপারে বলা চলে যে, স্বাস্থ্যখাত বিভিন্ন সময়ে কিছু মানুষের হাতে পড়েছে। তারা এটিকে রক্ত চুষে খাওয়ার মতো খেয়েছে। দুর্নীতি-অনিয়মের রাজত্ব কায়েম করে স্বাস্থ্যখাতকে ভঙ্গুরে পরিণত করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হন। তারপরও স্বাস্থ্যখাত থেকে দুর্নীতিবাজরা পুরোপুরি অপসারিত হয়েছে তা বলার সময় আসেনি। আশা করি, এবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ 'নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা' এই অগ্রধিকারটিকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্বাস্থ্যখাতের বেপরোয়া দুর্নীতিবাজদের হাতে শেকল পড়াবেন। তাদের জেলের ভাত খাইয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম করার জন্য কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
লেখক:
সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য পিপলস টাইম;
সহ-সভাপতি,
সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগ;
সাবেক পরিচালক, এফবিসিসিআই;
চেয়ারপারসন, ভোরের পাতা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।