নির্বাচন ঘিরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি সংসদ্বীয় আসনে দ্বন্দ্বে বিএনপি, শক্ত অবস্থানে জামায়াত

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি আসনে জমে উঠেছে রাজনৈতিক তৎপরতা। জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন বিএনপি ও জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ, প্রচার ও উঠান বৈঠকে সরব সময় কাটছে। তবে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব, বিভক্ত নেতৃত্ব ও একাধিক প্রার্থী থাকায় দলটি মাঠে দুর্বল অবস্থানে পড়েছে। অন্যদিকে জামায়াত একক প্রার্থী ঘোষণা করে সংগঠিতভাবে নির্বাচনী প্রচারে নেমেছে, ফলে তাদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জেলার তিনটি আসনেই বিএনপির বিভাজন ও জামায়াতের সুশৃঙ্খল সংগঠন কাঠামোর কারণে ধানের শীষ ও দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলছে।
সীমান্তঘেঁষা চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও পাঁচবারের সংসদ সদস্য অধ্যাপক শাহজাহান মিঞা। অন্যদিকে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন রাজশাহী মহানগরীর আমির ও দুবারের উপজেলা চেয়ারম্যান কেরামত আলী।
(নাচোল, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট) নিয়ে গঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী, দলের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. আমিনুল ইসলাম। অন্যদিকে জামায়াতের একক প্রার্থী মিজানুর রহমান।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি আসনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনকে। এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও চারবারের সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ। অন্যদিকে একই আসনে জামায়াতে ইসলামী থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির ও সাবেক শিবির নেতা নুরুল ইসলাম বুলবুল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সৈয়দ শাহিন শওকতকে প্রার্থী করার দাবিতে তাঁর সমর্থকরা রোববার বিকেলে শিবগঞ্জের কানসাটে শিবগঞ্জ-সোনা মসজিদ স্থলবন্দর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে আধা ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষোভকারীরা সাবেক এমপি শাহজাহান মিঞার মনোনয়ন বাতিল করে শাহিন শওকতকে প্রার্থী করার দাবি জানান। শিবগঞ্জ থানার পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে অবরোধ তুলে নেন।
এরপর ১১ নভেম্বর রাতে শিবগঞ্জের সোনামসজিদ ট্রাক টার্মিনালে বিএনপির সমর্থকরা মশাল মিছিল আয়োজন করেন। তারা বলেন, স্বাধীনতার পর পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত শাহজাহান মিয়া দীর্ঘ সময় বিদেশে অবস্থান করেছেন; তাই ত্যাগী নেতা ও রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদককে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়ায় তৃণমূল নেতাকর্মীরা হতবাক। তারা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে পুনর্বিবেচনার দাবি জানান এবং দাবি মেনে না নিলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন।
এদিকে শাহিন শওকত বলেন, বিক্ষোভের বিষয়ে তার জানা নেই, এটি সমর্থকদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন মাত্র; দল যে সিদ্ধান্ত নেবে, তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য মো. আমিনুল ইসলামের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে দলটির মনোনয়নবঞ্চিত অংশ। মঙ্গলবার বিকেলে নাচোল ডাকবাংলা মাঠে উপজেলা ও পৌর বিএনপির উদ্যোগে কর্মীসভা ও সমাবেশে নেতাকর্মীরা এই দাবি জানান। সমাবেশে জেলা ও উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দসহ মহিলা ও সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
বক্তারা বলেন, এই আসনে হাসিনা সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী নেতাদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দেওয়া হোক। তারা অভিযোগ করেন, সাবেক এমপি আমিনুল ইসলাম ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদে গিয়েছিলেন এবং এলাকায় কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তৃণমূল নেতাকর্মীরাও তাকে গ্রহণযোগ্য মনে করছেন না।
এ অবস্থায় মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা আমিনুল ইসলানের মনোনয়ন বয়কটের ডাক দেন। তারা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে হুঁশিয়ারি দেন যে, যদি দলের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে কঠোর আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের বিএনপি মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক মাসউদা আফরোজ হক শুচি সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন, দীর্ঘ ১৭ বছর রাজপথে দলের জন্য ত্যাগ ও সংগ্রাম করার পর সম্ভাব্য খসড়া মনোনয়ন না পাওয়া কষ্টদায়ক হলেও দলের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অটুট রয়েছে। তিনি বলেন, নেতৃত্ব সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে এবং আশা রাখছেন, ত্যাগ, নিষ্ঠা ও জনগণের ভালোবাসার মূল্য দল দেবে। তিনি নিজেকে নাচোল, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাটের মানুষের পাশে সবসময় থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মাসউদা আফরোজ হক শুচি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক দল হিসেবে মতভেদ, প্রশ্ন বা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি কোনো দুর্বলতা নয়, বরং শক্তি।
অন্যদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনে জামায়াতের মনোনয়নপ্রার্থী মাঠে এগিয়ে থেকে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সরাসরি প্রচারণা চালাচ্ছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট) ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনেও জামায়াত প্রার্থীরা সমাবেশ, পথসভা ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নির্বাচনী কার্যক্রমে সক্রিয় রয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তৃণমূল পর্যায়ে এই সক্রিয় প্রচারণা দলকে শক্ত অবস্থানে রাখছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তিন আসনের প্রতিযোগিতা অত্যন্ত কঠিন এবং জামায়াতের ঐক্যবদ্ধ ও সক্রিয় সংগঠন তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হিসেবে কাজ করতে পারে। নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা মাঠে প্রচারণা চালিয়ে ভোটারদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে এগিয়ে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোট যুদ্ধ অনেকটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মতোই প্রতীয়মান হচ্ছে।
নির্বাচনী প্রার্থীদের গণসংযোগ, উঠান বৈঠক এবং জনসভা চলমান থাকায় ভোটারদের মধ্যে চূড়ান্ত নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই তিন আসনে ধানের শীষ ও দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।