
জলবায়ু পরিবর্তনে অত্যন্ত ঝুঁকিপ্রবণ বাংলাদেশ। খরা কিংবা অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ নানা দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয় দেশের মানুষকে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত অনেকটা বৃষ্টিহীন কেটেছে। এর মাঝে ছিল তীব্র তাপপ্রবাহ। যার বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সামগ্রিক মৎস্য খাতে। মাছের প্রজনন মৌসুম সাধারণত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি—এ ছয় মাস। কিন্তু এ বছর খরা, তাপপ্রবাহ ও জলাশয়ে কম পানির কারণে চাহিদা সীমিত থাকায় পর্যাপ্ত রেণু পোনা উৎপাদন করতে পারেননি হ্যাচারি মালিকরা। এতে ভবিষ্যতে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন জেলার হ্যাচারি ও নার্সারি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে প্রজনন মৌসুম শুরু হলেও সাধারণত মে-জুনে সবচেয়ে বেশি রেণু বিক্রি হয়। সাধারণত রেণু পোনার অর্ডার পেলে কৃত্রিমভাবে এটি উৎপাদন করেন হ্যাচারি মালিকরা। কিন্তু চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত মাছ চাষের উপযোগী বেশির ভাগ পুকুরেই পর্যাপ্ত পানি ছিল না। এতে মৌসুমের প্রথম পাঁচ মাসে রেণু পোনার চাহিদা ছিল একেবারেই কম। আর আগস্টে বৃষ্টি শুরু হলে চাহিদা বাড়তে শুরু করলেও এ সময়ে মাছের প্রজনন কমে যায়। ফলে চাহিদা অনুযায়ী রেণু পোনা সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। আবার খরা ও তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে প্রাকৃতিকভাবেও রেণুর উৎপাদন ব্যাপক কমে গেছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য খামারিরা।
মৎস্য গবেষকরা বলছেন, প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোয় সাধারণত এপ্রিল-জুনে বৃষ্টি হলে পানি বৃদ্ধি পায়। এ সময় দেশীয় মাছ খাল-বিলের পানিতে ডিম ছাড়ে ও প্রজনন করে। আর মে-আগস্ট এ সময়ে মাছের বৃদ্ধি ঘটে। শীতকালে মাছের খুব বেশি বৃদ্ধি হয় না। কিন্তু এ বছর এপ্রিল-জুলাই অনেকটা বৃষ্টিহীন ছিল। খাল-বিলগুলোয় পর্যাপ্ত পানি ছিল না। আবার আগস্ট থেকে যখন বৃষ্টিপাত শুরু হয় তখন মাছের প্রজনন মৌসুম প্রায় শেষ। ফলে দেশের সামগ্রিক মৎস্য খাতে এবার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বছর জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়ার কারণে সারা দেশের মৎস্য খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া।
তিনি বলেন, ‘হ্যাচারিগুলো যে পোনা উৎপাদন করে সেগুলো যেসব জলাশয়ে ছাড়বে সেখানে এবার পানি ছিল না। এ কারণে হ্যাচারিগুলো খুব বেশি উৎপাদনে যেতে পারেনি। আবার সাধারণত মে-আগস্টে মাছের বৃদ্ধি বেশি হয়। তুলনামূলক শীতে কম। ফলে জলাশয়ে যেহেতু পানিই ছিল না, মাছও ফেলা হয়নি এ সময়ে—এতে স্বাভাবিকভাবেই মাছের উৎপাদন কমে যাবে। আবার প্রাকৃতিক জলাশয়ের দেশীয় মাছগুলো খালে-বিলে ডিম ছাড়ে এবং প্রজনন করে। এবার খালে-বিলেও পানি ছিল না তেমন। আর বৃষ্টি যখন শুরু হয় তখন প্রজনন মৌসুম শেষ। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিলগুলোয় দেশীয় মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এপ্রিল-জুনের বৃষ্টিতে খাল-বিলে পানি বাড়লে তখন দেশীয় মাছ প্রজনন করে। কিন্তু এ সময় এবার বৃষ্টি হয়নি। এসব কারণে এবার দেশীয় মাছের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুধু দেশীয় মাছ নয়, পুরো মৎস্য খাতেই এ প্রভাব দেখা যাবে।’
চিংড়ি চাষ: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ‘আধা নিবিড়’ চিংড়ি চাষেও, সফলতা এলেও নেই বিস্তার পরিবেশগত বিষয়াদি বিবেচনায় রেখে পরিবেশ বান্ধব “আধা নিবিড়” চিংড়ি চাষ হচ্ছে উপকূলীয় জেলায়। গত ৮ থেকে ১০ বছর ধরে এ চাষ চললেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। ফলে এ চাষ বিস্তার লাভ করেনি। তবে, ধৈর্য ধরে এ চাষে টিকে থাকায় সফলতার মুখ দেখছেন মো. কামরুল হাসান। ৮ থেকে ১০ বছর আগে সাতক্ষীরায় কিছু লোকজন নিয়ে আধা নিবিড় চিংড়ি চাষ শুরু করেন। কিন্তু সরে গেছেন অনেকেই। ধৈর্য নিয়ে থাকায় ২০২৪ সালে আনারুল আধা নিবিড় চিংড়ি চাষ থেকে সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা আয় হয়েছে। তিনি খামার পরিচালনা করছেন দেবহাটায়।
খামারিরা জানিয়েছেন, চিংড়ি চাষ নিয়ে তার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের পরও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘেরের পানির তাপমাত্রায় হঠাৎ পরিবর্তন আসে। যা চাষীদের ক্ষতি করে।”
তারা জানান, চিংড়ি চাষে সরকার অনুমোদিত বৈধ উপকরণ ব্যবহার করে থাকেন। চিংড়ি উৎপাদনে তিনি কখনো গ্রোথ হরমোন বা এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন না। সম্পূরক খাদ্য হিসেবে তিনি সর্বদা ভালো কোম্পানির মানসম্মত ফিড ব্যবহার করেন। আহছানিয়া ফিস খামার নামে বাগদা চিংড়ি খামারের কার্যক্রমের আওতায় তার খামারে রয়েছে ১২টি পুকুর। খামারের আয়তন ৯ হেক্টর। যার জলায়তন ৪.৮০ হেক্টর। এটি একটি আধা নিবিড় বাগদা চিংড়ি খামার। ২০২৪ উৎপাদন বছরে খামারের ৪.৮০ হেক্টর জলাশয়ের ১২টি পুকুরে ৬১.২৫ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন করেন। হেক্টর প্রতি ১২.৭৬ মে. টন বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়। প্রতি হেক্টরে ব্যয় হয় ৭০.৮৩ লাখ টাকা, আয় করেছেন ১০৯. লাখ টাকা। ফলে হেক্টর প্রতি তিনি লাভ করেছেন ৩৮.৫৪ লাখ টাকা।
দেবহাটা উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার মো. আবুবকর সিদ্দিক জানান, উপজেলায় বর্তমান ৩টি আধা নিবিড় বাগদা খামার রয়েছে। আধা নিবিড় খামার বাড়ানোর জন্য চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
কারণ, সনাতন পদ্ধতিতে যেখানে হেক্টর প্রতি মাত্র ৩৫০ কেজি বাগদা উৎপাদিত হয়, সেখানে আধানিবিড় পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কেজি বাগদা উৎপাদন সম্ভব।
দেবহাটা উপজেলা মৎস্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেবহাটা উপজেলায় ৪৫০ হেক্টর আয়তনের ৭৭৫টি গলদা ঘের রয়েছে। যার উৎপাদন ৮৮৯ মেট্রিক টন ও ৮৮৯৩ হেক্টর আয়তনের ৭,৪৬৯টি বাগদা চিংড়ি ঘের রয়েছে। যার উৎপাদন ৩৩৯০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে মাত্র ১১ হেক্টর আয়তনের ৩টি আধা নিবিড় বাগদা খামার রয়েছে। যার উৎপাদন ১৪৩ মেট্রিক টন। দেবহাটা উপজেলায় মাছের ৪,৯৩৩ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে ১০,৪৮১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ ৫,৫৪৮ মেট্রিক টন মাছ বেশি উৎপাদিত হয়। মাছ ও চিংড়ি চাষে সমৃদ্ধ এ উপজেলা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিতেও ভূমিকা রাখছে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম জানান, এ জেলায় ৫৪ হাজার ঘেরের ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে ২৬ হাজার মেট্রিক টন বাগদা ও ১১ হাজার ঘেরের ৯ হাজার হেক্টর জমিতে ১০ হাজার মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয়। এগুলো সাধারণ ঘের। পাশাপাশি ১১টি ঘেরে আধা নিবিড় পদ্ধতির চিংড়ি চাষ হয়। সেখানে হেক্টর প্রতি সর্বোচ্চ ৭ মেট্রিক টন ও সর্বনিম্ন ৩ মেট্রিক টন পর্যন্ত উৎপাদন হয়। কিন্তু এ চাষ পদ্ধতির শুরুতে খরচের পরিমাণ বেশি। আবার সাধারণ ঘেরের চেয়ে আধা নিবিড় পদ্ধতির চাষে উৎপাদন ৩-৪ গুণ বেশি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আধা নিবিড় চিংড়ি চাষেও পড়ছে। হঠাৎ বৃষ্টি, দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে গভীর ঘেরের পানির তাপমাত্রায় মারাত্মক পরিবর্তন ঘটে। যা চিংড়ির জন্য ক্ষতি করে। এ কারণে আধা নিবিড় চিংড়ি চাষের বিস্তার নেই। খরচ বাড়লেও উৎপাদন অনেক বেশি।
তিনি বলেন, “আধা নিবিড় চিংড়ি চাষের ঘেরের গভীরতা ৫ ফিট করার কথা বললেও অনেকেই খরচের কারণে ৩ ফিট করে রাখেন। যা চাতুর্যময়। এ কারণে তারা ক্ষতির মুখে পরেন। আবার অনাবৃষ্টির পর তাপ বেড়ে পানির তাপমাত্রায় পরিবর্তন হয়, অনেক বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় হঠাৎ বৃষ্টিতে আবার পানির তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত কমে যায়। পানিতে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন চিংড়ির জন্য হুমকি।”