প্রত্নসম্পদ ঘোষণার নয় বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি সংরক্ষণ, অবহেলা আর প্রশাসনিক দুর্বলতায় হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস

চাঁপাইনবাবগঞ্জের তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি ইলা মিত্রের ঝিনাইদহের বাগুটিয়ায় পৈতৃক ভিটেবাড়িটি ঘোষিত প্রত্নসম্পদ হলেও আজও দখলমুক্ত হয়নি। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক এই বাড়িটি ২০১৭ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ হিসেবে গেজেট প্রকাশ করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, বর্তমানে বাড়িটি হাজি কিয়ামউদ্দিন নামে এক ব্যক্তির দখলে রয়েছে, যিনি দাবি করছেন সম্পত্তিটি তিনি ইলা মিত্রের পরিবার থেকে ক্রয় করেছেন। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে বাড়িটি দখল করা হয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও অযত্ন- অবহেলায় পড়ে আছে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি, যা এখন ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে।
১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ইলা মিত্র। তাঁর বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে বাংলার অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। পরিবারের আদিনিবাস ঝিনাইদহের শৈলকুপা শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত বাগুটিয়া গ্রামে। সেখানে চুন-সুরকির তৈরি প্রায় ১৭ শতক জমির ওপর নির্মিত দুটি ভবন রয়েছে - একটি দোতলা এবং অন্যটি একতলা। ইলা মিত্র ১৯৪৪ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
বাগুটিয়া গ্রামে অবস্থিত কারুকার্যমণ্ডিত এই বাড়িটি ১৮৯৯ সালে নির্মাণ করেন ইলার দাদা রাজমোহন সেন। একসময় সজীব জীবন ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল ছিল বাড়িটি। এখন তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। ছাদের অনেকাংশ ভেঙে পড়েছে, দেয়ালে ধরেছে ফাটল।
সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশের পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যাখ্যা, জমি অধিগ্রহণ বা বাড়ির বর্তমান বাসিন্দাদের পুনর্বাসন বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে কোনও নির্দেশনা না আসায় তারা কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেননি।
এদিকে দখলদারদের বাধার কারণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরও এখনো সেখানে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ হিসেবে কোনো সাইনবোর্ড স্থাপন করতে পারেনি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বর্তমানে বাড়িটিতে বসবাস করছেন মৃত হাজি কিয়ামউদ্দিনের চার ছেলে - আলী হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, আবদুর রশিদ ও রাশিদুল ইসলাম। তারা দাবি করছেন, ১১৬নং মৌজার ২৩৪৫ দাগের ওপর ৮৪ বিঘা জমি ও বাড়িটি ক্রয় করেছেন স্থানীয় খোদা বক্স নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে।
কিয়ামউদ্দিনের নাতি আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ১৯৭০ সাল থেকে আমরা এখানে বসবাস করছি। সরকার চাইলে আমরা জায়গা ছাড়তে রাজি আছি, তবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসন শুধু দেখে যায়, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
বাড়ির একজন বাসিন্দা আলী হোসেন বিশ্বাসের ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিক জানিয়েছেন, নয়টি কক্ষের প্রাচীন একটি দোতলা বাড়ি এটি। পাঁচটি কক্ষ ব্যবহার করা যায়। তাদের পরিবারের সদস্যরা সেগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে ১৯৭০ থেকে বসবাস করছেন। বাকি কক্ষগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
বাগুটিয়া গ্রামে ১৮৯৯ সালে ইলা মিত্রের দাদা রাজমোহন সেন বাড়িটি নির্মাণ করেন। ছোটবেলায় গোপালপুর, শেখরা, রঘুনন্দপুর, শাহাবাজপুরসহ আশপাশের গ্রামে সময় কাটিয়েছেন এই নেত্রী। বাড়িটি এখন অযত্ন - অবহেলায় পড়ে আছে। সংক্ষরণের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ইলা মিত্রের পূর্বপুরুষরা দেশত্যাগের পর ১৯৭০ সালে বাড়িটি দখল হয়ে যায়। শুধু বাড়িই নয়, দখল হয়ে যায় তার বাবার শত শত বিঘা জমিও। যদিও এসব জমি সরকারের ভিপি খাতায় তালিকাভুক্ত, বাস্তবে তা প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। শুধু বাড়ি নয়, দখল হয়ে যায় তার বাবার রেখে যাওয়া শত শত বিঘা জমি। বর্তমানে যারা দখলে আছেন, কীভাবে আছেন, তা জানেন না এলাকাবাসী। দেয়ালে ঘেরা প্রাচীরের অনেক অংশ ভেঙে ফেলেছেন দখলদাররা।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ ইলা মিত্রকে নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই নতুনভাবে আগ্রহ ও সম্মান জেগে ওঠে। তাঁর পৈতৃক ভিটা দখলমুক্ত করার দাবি তখন থেকেই জোরদার হয়। ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন সংগঠন ও সচেতন নাগরিকেরা বাড়িটি সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন, মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি পেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এসব উদ্যোগের ফলেই ২০১৪ সালে বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে গেজেট প্রকাশিত হয়। তবে প্রায় এক দশক পার হলেও ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি এখনো দখলমুক্ত হয়নি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রশাসনের উদাসীনতাই এর প্রধান কারণ।
ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যসচিব আলমগীর অরণ্য বলেন, ইলা মিত্র ইতিহাসের অন্যতম নিপীড়িত রাজনীতিক, যিনি ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। অথচ আজ তাঁর পৈতৃক ভিটা অন্যের দখলে ও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তিনি বর্তমান বাসিন্দাদের পুনর্বাসন করে বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি জানান।
ইলা মিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুর রহমান মিল্টন বলেন, দীর্ঘ আন্দোলনের পর সরকার সংরক্ষণের নির্দেশ দিলেও স্থানীয় প্রশাসন তা উপেক্ষা করেছে। তিনি দ্রুত বাড়িটি দখলমুক্ত করার দাবি জানান।
সংগঠনের সদস্যসচিব সুজন বিপ্লবের মতে, এই বাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয় - এটি আমাদের ইতিহাস, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা জরুরি।
সিপিবি ঝিনাইদহের সাধারণ সম্পাদক আবু তোয়াব অপু বলেন, বাড়ি সংরক্ষণ, ইলা মিত্রের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন ও তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ নানা দাবিতে দেশব্যাপী কর্মসূচি চলছে।
বাগুটিয়ার জরিপ বিশ্বাস কলেজের শিক্ষক হাবিবুল ইসলাম বলেন, সংরক্ষণের ঘোষণা আসার প্রায় এক দশক পরও প্রশাসন একটি সাইনবোর্ড পর্যন্ত দেয়নি, যা তাদের গাফিলতির পরিচায়ক।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্নিগ্ধা দাস জানান, বর্তমান বাসিন্দারা সম্পত্তিটি ক্রয় করা বলে দাবি করছেন; পুনর্বাসনের নির্দেশনা না আসায় পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আওয়াল বলেন, গেজেট প্রকাশের পরও মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না থাকায় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের উপপরিচালক লাভলী ইয়াসমিন জানান, ২০১৭ সালে সাইনবোর্ড স্থাপন করতে গেলে বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল; জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা পেলে পুনরায় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
১৮ অক্টোবর ইলা মিত্রের জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হয়। এ উপলক্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আয়োজন করা হয় শোভাযাত্রা ও কৃষক সমাবেশ। বক্তারা বাড়িটি দ্রুত দখলমুক্ত করে সংরক্ষণের দাবি জানান।
প্রায় এক দশক আগে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসনিক উদ্যোগের অভাবে দখলমুক্ত হয়নি ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়ি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইতিহাসের সাক্ষী এই স্থাপনাটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এলাকাবাসীর দাবি - সরকার দ্রুত উদ্যোগ নিয়ে ঐতিহাসিক এই বাড়িটিকে সংরক্ষণ করুক, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে তেভাগা আন্দোলনের সেই অবিস্মরণীয় নায়িকার গল্প।
উল্লেখ্য গতকাল শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায় তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি ও আদিবাসীদের ‘রাণীমা’ খ্যাত ইলা মিত্রের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন করা হয়েছে। শনিবার দুপুরে ইলা মিত্র জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে জেলা শহরের ফায়ার সার্ভিস মোড় থেকে একটি শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে পৌর পার্কে এসে আদিবাসী ও বাঙালি কৃষক সমাবেশে মিলিত হন।
বক্তারা বলেন, রাণী ইলা মিত্র ছিলেন কৃষক অধিকার ও নারীর মর্যাদার প্রতীক। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। কৃষক আন্দোলনের সময় তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। তাঁর সংগ্রামী জীবন নতুন প্রজন্মকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা জোগাবে।