
চাঁপাইনবাবগঞ্জ টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি নতুন গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমান প্রিন্সিপাল জনাব প্রকৌশলী মোঃ আবদুর রহিম দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিষ্ঠানটিতে অবকাঠামোগত ও প্রশিক্ষণমূলক দিক থেকে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তাঁর নেতৃত্বে টিটিসি আজ দেশের অন্যতম আধুনিক ও কার্যকর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
প্রিন্সিপাল প্রকৌশলী মোঃ আবদুর রহিম যোগদানের পর টিটিসিতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সম্পন্ন হয়েছে। নতুন ভবন ও ক্লাসরুম সংস্কার, আধুনিক মেশিনারিজ সংযোজন, প্রশিক্ষণ কক্ষ ও ওয়ার্কশপ উন্নয়ন, নারী প্রশিক্ষণার্থীদের অংশগ্রহণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
বর্তমানে টিটিসির পুরো ক্যাম্পাস ৩৪টি সিসি ক্যামেরার আওতায় এসেছে। নির্মিত হয়েছে ডিজিটাল মেইন গেইট, অধ্যক্ষের কক্ষ ও সম্মেলন কক্ষ আধুনিকায়ন করা হয়েছে, ক্লাসরুমে মাল্টিমিডিয়া সংযোজনসহ হাজিরা ব্যবস্থায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বাউন্ডারি ওয়ালে কাঁটাতারের বেড়া সংযোজন করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসিতে প্রতিদিন শত শত বিদেশগামী শ্রমিক তিন দিনের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন। প্রশিক্ষণ শেষে তারা সার্টিফিকেট পান, যা বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রশিক্ষণকালে তাদের শেখানো হয় গন্তব্য দেশের প্রাথমিক ভাষা, নিরাপদ কর্মপদ্ধতি, শ্রম আইন, অভিবাসন আইন ও সাংস্কৃতিক অভিযোজন বিষয়ক পাঠ।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকরা জানিয়েছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসির প্রশিক্ষণ গ্রহণের ফলে তারা বিদেশে গিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন এবং আগের তুলনায় আয়ও বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতি মাসে গড়ে সাত শতাধিক বিদেশগামী কর্মী তিন দিনের প্রি-ডিপার্চার প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন। এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতেও সহায়তা করছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় তিন হাজারের বেশি বেকার যুবক-যুবতীকে বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষ করে তুলছে। এতে তারা শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে দেশের দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রতিষ্ঠানটির অবদান ক্রমেই বাড়ছে। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই টিটিসি এখন উত্তরাঞ্চলের অন্যতম আধুনিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, যেখানে প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো ও মানসম্মত প্রশিক্ষণের সমন্বয়ে হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসির খণ্ডকালীন অতিথি ভাষা প্রশিক্ষক (জাপানিজ ভাষা)মোঃ ইমরান হোসেন বলেন, ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে জাপানিজ ভাষা (N৫) কোর্স চালু করা হয়। এ পর্যন্ত মোট ৪৭৭ জন প্রশিক্ষণার্থী সফলভাবে এই কোর্স সম্পন্ন করেছেন, যার মধ্যে ১৭০ জন সরকারিভাবে চাকরি নিয়ে জাপানে গমন করেছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসির খণ্ডকালীন অতিথি ভাষা প্রশিক্ষক (জাপানিজ ভাষা N৪) মোঃ রনিফুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাপানিজ ভাষা (N৪) কোর্স চালু করা হয়। এ পর্যন্ত মোট ৩৭ জন প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন, এর মধ্যে একজন ইতোমধ্যে SSW ভিসায় জাপান গেছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসির খণ্ডকালীন অতিথি ভাষা প্রশিক্ষক (কোরিয়ান ভাষা) এইচ. এম. এল. এইচ. রাজু জানান, ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে চালু হওয়া কোরিয়ান ভাষা কোর্সে এ পর্যন্ত ৫৬৮ জন প্রশিক্ষণার্থী সফলভাবে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন, যার মধ্যে ১০০ জনেরও বেশি প্রশিক্ষণার্থী বর্তমানে কোরিয়ায় কর্মরত আছেন।
টিটিসির সব প্রশিক্ষকই NTVQF LEVEL- 1 সনদপ্রাপ্ত। এর মধ্যে ১১ জন প্রশিক্ষক NTVQF LEVEL-4 (Trainer and assessor) সম্পন্ন করেছেন। একজন প্রশিক্ষক NSDA-এর অধীনে Assessor প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন।
এছাড়া ১২ জন প্রশিক্ষক চীনে এবং একজন সিঙ্গাপুরে বিদেশে দক্ষতা প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন, যা প্রশিক্ষণের মান আরও উন্নত করতে সহায়ক হয়েছে।
টিটিসির ভর্তি ও সনদ প্রদান কার্যক্রম এখন সম্পূর্ণ অনলাইন ভিত্তিক। প্রশিক্ষণার্থীদের কর্মসংস্থান ও চাকরিদাতাদের সংযোগ সহজ করতে তৈরি করা হয়েছে অনলাইন জব পোর্টাল।
এছাড়া BMET ও SEIP প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৪০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে বিনামূল্যে আধুনিক গাড়িতে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে এবং তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাসিক ৩৩০০ টাকা ভাতা প্রদানের ব্যবস্থাও রয়েছে।
সৌদি আরবগামী কর্মীদের TAKMOL অ্যাসেসমেন্ট এখন সরাসরি চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসিতেই সম্পন্ন হচ্ছে। ফলে কর্মীদের আর ঢাকায় যেতে হচ্ছে না। এই সুবিধা উত্তরাঞ্চলের অভিবাসন প্রত্যাশী শ্রমিকদের জন্য বড় স্বস্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
প্রশিক্ষন ইনচার্জ ও সিনিয়র শিক্ষক মোঃ সাঈদী হোসেন জানান ২০১৮ সালের জাতীয় উন্নয়ন মেলায় জেলা পর্যায়ে “শ্রেষ্ঠ স্টল” নির্বাচনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। এছাড়া ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি National Skills Development Authority ( NSDA)-এর অনুমোদন লাভ করে এবং এখন পর্যন্ত ২০টি অকুপেশনে কোর্স চালুর অনুমোদন পেয়েছে।
জাপানে কর্মরত আব্দুল আহাদ জানান গত বছর তারা একসাথে ২৫ জন শিক্ষার্থী জাপানে একসাথে গমন করছেন। তারা প্রতিমাসে এক লক্ষ ৫০ হাজার টাকা নিজ বাড়িতে প্রেরন করেন। তিনি জাপানীজ কোম্পানির মালিকরা অনেক ভালো ও অমায়িক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসির প্রিন্সিপাল প্রকৌশলী মোঃ আবদুর রহিম বলেন, আমাদের লক্ষ্য বিদেশগামী প্রতিটি শ্রমিককে সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা, যাতে তারা বিদেশে দেশের সুনাম বয়ে আনতে পারে এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে। দক্ষতাই উন্নয়নের চাবিকাঠি-এ বিশ্বাসে আমরা কাজ করছি।
”একটাই লক্ষ্য, হতে হবে দক্ষ”- এই স্লোগানকে সামনে রেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জ টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি আজ উত্তরাঞ্চলের তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থানের প্রধান ভিত্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।