ঝিকরগাছায় গ্রামীন অবকাঠামোসহ কৃষি বিভাগের দুর্নীতির লাগাম টানতে গিয়ে অধস্তনদের রোষানলে পড়েন ইউএনও!

যশোরের ঝিকরগাছায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পসহ আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত কৃষি বিভাগের সীমাহীন দুর্নীতির লাগাম টানতে গিয়ে অধস্তন কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েন ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ভুপালী সরকার।
তিনি কৃষকদের মাঝে বরাদ্দকৃত কৃষি প্রণোদনার নগদ অর্থ, সার,বীজ,উপকরণ, কৃষি প্রশিক্ষণ,বৃক্ষরোপণ, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, খাদ্যবান্ধব ডিলার নিয়োগ ও বিসিআইসি ডিলারদের সাথে গাটছড়া দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ জাহাঙ্গীর আলমসহ কতিপয় প্রশাসকের দুর্নীতির লাগাম টানতে গিয়ে অধস্তন কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েন বলে অভিযোগ। উপজেলা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় হতদরিদ্রদের মাঝে ওএমএস, ভিজিএফ, ভিজিডি, ভিডব্লিউবিসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বরাদ্দকৃত সরকারি এই বিপুল অর্থের প্রকল্প ব্যয়, কাজের গুণগতমান,স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মাঠ পর্যায়ে তদন্তের নির্দেশনা দেন তিনি।
তদন্তে একে একে বেরিয়ে পড়তে থাকে ব্যাপক কারচুপি,অনিয়ম ও দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য।
গ্রামীণ কাঠামো নির্মাণে নিম্নমানের ইটবালুসহ নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করায় কোনো কোনো প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেন ইউএন। কাজের দরপত্র বা সিডিউলের শর্তানুযায়ী কোনো কোনো ঠিকাদারকে কাজের গুণগতমান বুঝে দিতে বাধ্য করেন এই সরকারি কর্মকর্তা। জানাগেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার আত্মীয় পরিচয়ের ওই প্রভাবশালী ঠিকাদার কর্তৃক অন্যত্র বদলির হুমকিও দেয়া হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে । তারপরও সিডিউল অনুযায়ী মানসম্মত কাজ করতে ইউএনও'র চাপসৃষ্টিতে চাপাক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও কমিশন বাণিজ্যলোভী ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় প্রশাসক ও সচিবরা। উপজেলার শিমুলিয়া,শংকরপুর, হাজিরবাগ নির্বাসখোলা,ঝিকরগাছা সদর ইউনিয়নে গ্রামীন অবকাঠামো নির্মাণে ব্যাপক কারচুপি ও কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি গণমাধ্যম কর্মী ও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সামনে উঠে এসেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি গ্রামীণ অবকাঠামো ইটের সোলিং রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প থেকে ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা অংকের কমিশন বাণিজ্য করেছেন কতিপয় প্রশাসক ও সচিব। উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের গ্রামীন অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প থেকে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের কাছ থেকে ১৪লাখ টাকা কমিশন নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক ও উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার কামরুজ্জামান ব্যক্তিগতভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন ৬লাখ টাকা। একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় একজন নেতা ভাগ নিয়েছেন ৫০হাজার টাকা। কমিশন বাণিজ্যের এই টাকার একটি বড় অংশ অন্যদের মাঝেও ভাগ বাটোয়ারা করা হয়েছে বলে জানাগেছে ।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে চলমান (সদ্যসমাপ্ত) গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন এসব প্রকল্প পজীব কর্মকর্তা (উপজেলা নির্বাহী অফিসারের প্রতিনিধি) 'র পাশাপাশি নিজেও সরেজমিন তদারকি করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ভুপালি সরকার । ফলে, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য সকল প্রকল্পের কমিশন বাণিজ্যের সুবিধাভোগী দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তাদের গাত্রদাহের কারণ হন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। জানাগেছে, উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটি,সার-বীজ মনিটরিং কমিটি, কৃষি প্রণোদনা কমিটিসহ প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে তিনি যখন কঠোর মনোভাব প্রকাশ করে চলেছেন তখনই দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একট্টা ও জোটবদ্ধ হন বলে অভিযোগ। তাকে বদলি করতে উঠে পড়ে লাগেন উপজেলা প্রশাসনের একাধিক সরকারি কর্মকর্তা। যাদের মধ্যে অন্যতম উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ জাহাঙ্গীর আলমসহ অধস্তন উপজেলা পজীব কর্মকর্তা আনিসুর রহমান, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা অনিতা মল্লিক, একাডেমিক সুপারভাইজার কামরুজ্জামান,প্রকল্প বাস্তবায়ন(পিআইও) কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম । উপজেলা নির্বাহী অফিসারের প্রতিনিধি পজীব কর্মকর্তা আনিসুর রহমান দাবি করেছেন তিনি কোন ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত নন। তিনি নিজেই ষড়যন্ত্রের শিকার।
এসব কর্মকর্তাদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রকে ইতিহাসের কলঙ্কিত 'কাশিমবাজার কুঠির' ষড়যন্ত্রকেও হার মানিয়েছে বলে মন্তব্য করেন অনেকে।একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এধরনের গভীর চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র প্রশাসনের 'চেইন অব কমান্ড'র জন্য যেমন বড় হুমকি,তেমনি রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজে বাধা সৃষ্টি করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল কিনা এমন প্রশ্ন তুলেছেন ।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, হতদরিদ্র সুবিধাভোগীর (ভিডব্লিউবি)'র তালিকায় ২২হাজার ৮'শ২৫জনের নাম ছিল। বহুসচ্ছল পরিবারের ওই তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি হয়েছে মর্মে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ আসে। এরই প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ভূপালী সরকার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাভিদ সারওয়ারকে প্রদান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। মাঠ পর্যায়ে এই তালিকা প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা অনিতা মল্লিক। পূর্ণরতদন্তে ব্যাপক গোজামিল, গড়মিল ও অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে। ওই তালিকা থেকে বাদ পড়েন ৩০৭জন সুবিধাভোগীর নাম। জানাগেছে,সচ্ছল ব্যক্তিদের তালিকাভুক্তির বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা অনিতা মল্লিক। এদিকে কৃষি প্রণোদনার সুবিধাভোগী কৃষকদের তালিকা প্রস্তুতকারী একাধিক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার সদর ইউনিয়নের কৃষি প্রণোদনার সুবিধাভোগীদের তালিকায় ব্যাপক গরমিল-গোজামিল লক্ষ্য করা গেছে। ব্যাপক অসামঞ্জস্য ও ত্রুটিপূর্ণ কৃষকের তালিকার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সন্তোষজনক কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছেনা।
অবস্থাদৃষ্টে প্রতিমান হচ্ছে নির্বাচিত সরকারের জনপ্রতিনিধি না থাকায় কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তারা লাগামছাড়া দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, মাঠ পর্যায়ের তদন্তে উঠে আসা এসব চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির বিষয়ে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ভূপালী সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা।