
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা-১ আসন (তালা-কলারোয়া) এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতে ইসলামীর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে এবারও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। স্বাধীনতার পর থেকে অনুষ্ঠিত ১২টি নির্বাচনের ফলাফল ঘেঁটে দেখা যায়—এখানে পাল্টাপাল্টি জয় পেলেও আওয়ামী লীগ, জামায়াত, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি প্রত্যেকেই রেখেছে শক্ত উপস্থিতি।
স্বাধীনতার পর থেকে ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের পৃথক অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য ১২ জুন ১৯৯৬-এর নির্বাচন ও ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে সাতক্ষীরা-১ আসনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় আওয়ামী লীগের সৈয়দ কামাল বখত পান ৩৫.৬% ভোট। জামায়াতের শেখ আনসার আলী পান ৩১.৩৫% ভোট। বিএনপির হাবিবুল ইসলাম হাবিব ও এবিএম আলতাফ হোসেন পান ১৮.৬% ভোট। জাতীয় পাটির সৈয়দ দিদার বখত পান ১২.৯% ভোট। অর্থাৎ সাতক্ষীরার তালা ও কলারোয়া নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-১ আসনে আ. লীগ প্রথম, জামায়াত দ্বিতীয়, বিএনপি তৃতীয় ও জাতীয় পাটির অবস্থান চতুর্থ। স্বাধীনতা পরবর্তী ১১টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী চারবার, বিএনপি-জামায়াত জোটগতভাবে একবার, বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি একবার, জামায়াত এককভাবে একবার, জাতীয় পার্টি একবার, ওয়ার্কার্স পার্টি নৌকা প্রতীক নিয়ে দুবার এবং মুসলিম লীগ প্রার্থী একবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়।
সাতক্ষীরার তালা ও কলারোয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে দুটি উপজেলার ২৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ভোটার প্রায় পাঁচ লাখ। ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিএনপি কিংবা জামায়াত নেতাকর্মীরা বেশ উজ্জীবিত।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগকে জনগণ আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। অন্যদিকে বিএনপির একাধিক প্রার্থী জনগণের মন জয় করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জোটগত নির্বাচন ছাড়া এককভাবে আসনটিতে বিএনপি কখনো জয়লাভ করতে পারেনি। অন্যদিকে জামায়াতের একক হেভিওয়েট প্রার্থী, সাংগঠনিক মজবুতি, এককভাবে জয়সহ সাধারণ ভোটারদের কাছে জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন দলের নেতাকর্মীরা। সব দলের অংশগ্রহণে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তালা-কলারোয়ায় বিতর্কিত নির্বাচনে নির্বাচিত হন মহাজোট প্রার্থী আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পেয়েছিলেন ১ লাখ ৬৮ হাজার ২৯৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত জোটের হাবিবুল ইসলাম হাবিব পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪১ হাজার ১৬৪ ভোট।
এ আসনের একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাতক্ষীরা-১ আসনে বিএনপির বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী ও জামায়াতের একক প্রার্থীর রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখা গেছে। আলোচনা আছে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও দেখা যেতে পারে একাধিক ব্যক্তিকে।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নেতাকর্মীদের নিয়ে জনগণকে সংগঠিত করতে শুরু করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, সাতক্ষীরা জামায়াতের সাবেক জেলা আমীর, অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ।
প্রচার-প্রচারণায় ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ও সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাবিবুল ইসলাম হাবিব। অন্যদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রাপ্তির প্রত্যাশায় কাজ শুরু করেছেন সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কলারোয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র আক্তারুজ্জামান। একইভাবে এলাকায় যোগাযোগ বাড়িয়েছেন দৈনিক ইত্তেফাকের রাজনীতি ও নির্বাচক বিষয়ক সম্পাদক সাবেক ছাত্রদল নেতা সাইদুর রহমান।
জামায়াত মনোনীত একক প্রার্থী অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ বলেন, আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি। তাদের কথা শুনছি। আলোচনা সভা, উঠান বৈঠক, জনসংযোগ, পথসভায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আমরা অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আমরা জুলাই শহীদ ও যোদ্ধাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে তালা-কলারোয়াবাসীকে সাথে নিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। আগামী নির্বাচনে জনগণ যদি আমাদের সমর্থন দেয়, তাহলে একটি ‘শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে তালা-কলারোয়া পানিবদ্ধতার স্থায়ী নিরসন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, রাস্তাঘাটা নির্মাণ করা, হিন্দু সম্প্রদায়সহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধীকার নিশ্চিত করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আধুনিকায়নসহ একটি সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজমুক্ত তালা-কলারোয়া গড়ে তোলা হবে।
সাতক্ষীরা-১ আসনের সাবেক এমপি, কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ও সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাবিবুল ইসলাম হাবিব বলেন, তালা-কলারোয়ার মানুষের কাছ থেকে আমাকে দূরে রাখতে মিথ্যা মামলায় ৭০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তালা-কলারোয়ার মানুষ আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছে, তা ভোলার নয়, তাদের পাশে থেকেই আজীবন সেবা করতে চাই। দল আমাকে আগেও জনগণকে সেবা করার সুযোগ দিয়েছে, আমার পরীক্ষা নিয়েছে। আমি জনগণের সেবা করে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। আগামীতেও জনগণকে সেবা করার সুযোগ পাব বলে আমি মনে করি, যদিও বিষয়টি দলের ওপরই নির্ভর করবে।
সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কলারোয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র আক্তারুজ্জামান বলেন, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। শুধুমাত্র বিএনপি করার কারণে আমাকে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয়েছে। তারপরও মানুষ আমাকে ভালোবেসে দুবার মেয়র নির্বাচিত করেছে। দল চাইলে বিএনপির মনোনয়ন নিয়েই আগামীতে সাতক্ষীরা-১ আসনে প্রার্থী হবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা সাইদুর রহমান বলেন, আমি বিগত পাঁচ-সাত বছর ধরে সাতক্ষীরায় বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রমে জড়িত। জেলার তরুণ নেতৃত্বের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হয়নি, তারপরও দল চাইলে- দল যদি মনে করে তরুণ নেতৃত্ব এগিয়ে আসুক, তাহলেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেবো।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, সাতক্ষীরা জামায়াতে ইসলামীর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তাই ৩৬ জুলাই পরবর্তী জনগণের যে মানসিকতা তাতে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান আরো ভালো হয়েছে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। তাই শেষ পর্যন্ত ভালো ইমেজ যারা ধরে রাখতে পারবে গণরায় তাদের পক্ষেই পড়বে এতে সন্দেহ নেই। তারপর আর একটি বিষয় প্রার্থীদের মাথায় রাখতে হবে, তা হলো পতিত আওয়ামী লীগ ও প্রতিবেশী দেশ ভারত ও ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার প্রস্তুতি।