
টাঙ্গাইলে চাঞ্চল্যকর কলেজছাত্রী এশাকে ধর্ষণ মামলার বাদী এশা মির্জাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং টাঙ্গাইল সদর থানায় কর্মরত পুলিশের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের আলামত লোপাটের অভিযোগ উঠে এসেছে।
সাবেক ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগটি করেছেন মামলার বাদি নিহত এশার বড় বোন লুনা মির্জা।
তিনি জানান, তার ছোট বোন নিহত হওয়ার পূর্বে একাধিকবার বিভিন্নভাবে পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে, তাকে যে কোন সময় হত্যা করা হতে পারে। এমনকি তিনি মৃত্যুর আগে সংবাদ সম্মেলন করে তাকে জীবনের শঙ্কার বিষয়টি জানালেও তখন টাঙ্গাইল সদর থানার দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুস ছালাম মিয়া এশার নিরাপত্তার জন্য কোন প্রকার ব্যবস্থা নেননি।
নিহত এশার সেই শঙ্কাটি তাকে হত্যা করার মাধ্যমে সত্যতে পরিণত হলেও পুলিশ কোটি টাকার বিনিময়ে হত্যা মামলাটির আলামত লোপাট করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেবার সকল চেষ্টা করেছেন বলে জানান নিহত এশা মির্জার বড় বোন ও এশা হত্যা মামলার বাদি লুনা মির্জা।
মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি বাংলাদেশ বুলেটিনকে অভিযোগ করে জানান, এই বিষয়ে তিনি একটি মামলার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
লুনা মির্জা অভিযোগ করে বলেন, এশাকে যে রাতে হত্যা করা হয়, সেই সময় সাংবাদিকসহ অন্য কাউকে ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। ওসি আব্দুস ছালাম সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন বলেও তিনি জানান। তিনি আরো জানান, কোটি টাকার বিনিময়ে তিনি সকল আলামত লোপাট করেছেন। তা না হলে সব কাজ ফেলে কেন তিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওই বাড়িতে অবস্থান করবেন? তিনি বড় মনি ও ছোট মনিরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের পরামর্শ মতোই এই আলামত লোপাট করেছেন বলেও অভিযোগ করেন। এছাড়া প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানান, সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ওসি সালাম নিহত এশা মির্জার ফ্লাটে অবস্থান করেছেন।
লুনা মির্জা অভিযোগ করে বলেন, মামলার পর থেকে এশা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। সে জন্য আমি লুনার নিরাপত্তার জন্য বাসার গেট থেকে শুরু করে দরজা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সিসি (ক্লোজড সার্কিড) ক্যামেরা লাগাই। সেই ক্যামেরার ফুটেজগুলো ওসি’র মামলার জব্দ তালিকায় নেই। এই ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই এশার মৃত্যুর আসল রহস্য উদঘাটিত হবে বলেও দাবি করেন তিনি ।
এসময় তিনি আরো বলেন, এশার দুটি আইফোন ওসি ছালাম নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন, পরবর্তীতে আমার পিরাপিড়িতে জব্দ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু সিসি ক্যামেরাগুলো যে জব্দ তালিকায় জমা দেয়নি সেটা পরে জানতে পারি।
এর আগে ২০২৩ সালের ৫ এপ্রিল রাতে টাঙ্গাইল সদর থানায় বড় মনিরের বিরুদ্ধে ওই কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করা হয়। মামলায় ধর্ষণের কারণে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। মামলায় বড় মনিরের স্ত্রী নিগার আফতাবকেও আসামি করা হয়।
মামলার পর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, বড় মনি ও তার স্ত্রী নিগার আফতাব নিহত এশা মির্জাকে নিয়ে তার বাড়িতে একটি খাটের উপর বসে আছে। সে সময় বড় মনি নিহত এশা মির্জাকে বারংবার শারীরিকভাবে নির্যাতন করছে। তবে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কিশোরীকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া না গেলেও অন্তঃসত্তার প্রমাণ পায় মেডিকেল বোর্ড। পরে গত ৬ এপ্রিল দুপুরে আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দেন ওই কিশোরী।
এরপর ওই বছর ২১ আগস্ট ধর্ষণ মামলায় বড় মনিরের হাইকোর্টের দেওয়া জামিন গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত থাকবে বলে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এ সময়ের মধ্যে ধর্ষণের শিকার ওই নারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া নবজাতকের ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেন আদালত। তার আগে ওই বছর ১৫ মে টাঙ্গাইলের চিফ জুডিশিয়াল আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেন বড় মনি। পরে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাহমুদুল মহসীন জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এদিকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন এক বেসরকারি ক্লিনিকে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন এশা। পরবর্তীতে, ১১ জুলাই বিচারপতি শেখ জাকির হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ বড় মনিরকে জামিন দেন। পরে জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর চেম্বার আদালত তার জামিন স্থগিত করে দেন। ২১ আগস্ট ধর্ষণ মামলায় বড় মনিরের হাইকোর্টের দেওয়া জামিন ৯ অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত থাকবে বলে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এ সময়ের মধ্যে ধর্ষণের শিকার ওই নারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া নবজাতকের ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেন আদালত। শিশুটির জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) পিতা বড় মনির নন; ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে এ তথ্য আসে। ৯ অক্টোবর তাকে জামিন দেন আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের আপিল বেঞ্চ।
মামলার এজাহারে বলা হয়-ভাইয়ের সঙ্গে ওই কিশোরীর পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ হয়। এ নিয়ে বড় মনির সঙ্গে কিশোরীর হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। সমস্যা সমাধান করে দেওয়ার আশ্বাস দেন মনি। ১৭ ডিসেম্বর শহরের আদালতপাড়ায় মনি ১০ তলা ভবনের চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে যেতে বলেন। সেখানে গেলে ওই কিশোরীকে শারীরিক সম্পর্ক করার প্রস্তাব দেন মনি। রাজি না হওয়ায় তার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাকে একটি কক্ষে আটকে রাখেন। প্রায় তিন ঘণ্টা পর কক্ষে প্রবেশ করে তাকে বড় মনি ধর্ষণ করেন। ধর্ষণ শেষে কারও কাছে এ ঘটনা প্রকাশ করতে নিষেধ করেন বড় মনি। প্রকাশ করলে প্রাণে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়।
ওই ঘটনার পর থেকে ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং প্রথমবার ধর্ষণের সময় তোলা ছবি দেখিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করতে থাকে বড় মনি। এতে কিশোরীটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এ কথা বড় মনিকে জানালে তাকে গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য চাপ ও হুমকি দেওয়া হয়। সন্তান নষ্ট করতে রাজি না হওয়ায় ২৯ মার্চ রাত ৮টার দিকে মনি তাকে আদালতপাড়ার বাড়িতে তুলে নিয়ে যান। সেখানে গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। রাজি না হওয়ায় বাসায় এক কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। সেখানে তাকে আবারও ধর্ষণ করেন বড় মনি। একপর্যায়ে তার স্ত্রী কিশোরীকে মারধর করেন। এতে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত ৩টার দিকে তাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। তাকে নানা হুমকিও দেওয়া হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিহত এশা মির্জার বড় বোন লুনা মির্জা আরো অভিযোগ করে বলেন, এশার ধর্ষণ মামলার পর থেকে মনি পরিবারের ঝড় নেমে আসে তাদের পরিবারের উপর। সেই ঝড়ের প্রতিকূল প্রান্তে থাকে তারই ভাই জনি মির্জা।
জনি মির্জা বড় মনির কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে সংবাদ সম্মেলন করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এসময় তিনি বলেন, সংবাদ সম্মেলনে আমার ভাই জনি মির্জা – বড় মনির পক্ষে সাফাই গায় ও এশা মির্জাকে মাদকাসক্ত বলে উপস্থাপন করে।