
গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুর্বৃত্তদের ককটেল বিস্ফোরণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা জায়গায় পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দলের আগামী ১৩ নভেম্বর লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা জোরদার করেছে প্রশাসন। যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই কর্মসূচিকে ঘিরে কোনো ধরনের নিরাপত্তা হুমকি নেই।
গত কয়েক দিনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঢাকায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে, ডিএমপির ৫০টি থানায় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, পুলিশ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে থাকার দাবি করলেও কার্যত মাঠপর্যায়ে এর প্রভাব পুরোপুরি লক্ষ্য করা যায়নি। গত কয়েক দিনে দুর্বৃত্তরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যানবাহন থেকে শুরু করে বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে। এছাড়া, মুখোশ ও হেলমেট পরিধানকারী একদল লোক রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নির্বিচারে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
দুর্বৃত্তরা শুধু ককটেল বিস্ফোরণ বা বাসে আগুন দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করছে। সর্বশেষ, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের গার্লস শাখায় পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। যদিও এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট, সচিবালয়সহ প্রধান প্রধান সরকারি অফিসগুলোতে পুলিশের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
পুলিশ, র্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করছেন।
বিশেষ নজর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এসব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ছাড়াও রাজধানীর বনানী, উত্তরা, বাড্ডা, পল্টন ও ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তবে, বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ সম্পূর্ণ ধানমন্ডি এলাকায়।
ধানমন্ডি থানা সূত্রে জানা যায়, বিশেষ করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের নাশকতার ঘটনা যেন না ঘটতে পারে, সেজন্য গত দুই দিন ধরেই সেখানে পুলিশের ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। সন্দেহজনক যান চলাচল দেখলে পুলিশ ব্যারিকেডে আটকে তল্লাশি করছে।
গত কয়েক দিনের ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে রাতের বেলায়। সেজন্য রাতে যেন কোনো ধরনের নাশকতার ঘটনা না ঘটতে পারে, সেজন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও কার্যক্রম গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও থানায় বাড়তি নজর
ঢাকার বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ডিএমপি।
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজধানীর বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দলের আগামীকালের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রতিটি থানার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক যে ঘটনাগুলো ঘটছে, এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাশকতার শঙ্কায় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকে শুরু করে প্রতিটি থানার সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৮ থেকে ১০ জন করে অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
রমনা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম ফারুক বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় গত কয়েক দিন ধরে রমনা থানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শুধু থানায় নয়, রমনা থানার অধীনে যেসব এলাকা আছে, সেসব এলাকায়ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
ডিএমপির শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খালিদ মনসুর বলেন, থানার সামনে বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েনের বিষয়টি স্বাভাবিক নিরাপত্তা কার্যক্রম। এছাড়া, শাহবাগ থানা এলাকায় প্রায়ই দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংঘটিত হয়। এসব বিষয় এবং বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় রেখে বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তবে, বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
সারাদেশে বিজিবি মোতায়েন
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় ১৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বুধবার বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীসহ ঢাকায় ১২ প্লাটুন ও আশপাশের জেলায় দুই প্লাটুনসহ মোট ১৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
গত ১১ দিনে ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণ ও নয়টি যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনার পরও ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী দাবি করেন, ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
মঙ্গলবার বিকেলে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ঢাকাবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ১৩ নভেম্বর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তা ভিত্তিহীন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা প্রস্তুত আছি। ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক ভালো।
নিষিদ্ধ দলের সম্ভাব্য নাশকতার আশঙ্কা প্রসঙ্গে কমিশনার বলেন, এক-দুটি মোটরসাইকেল থেকে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এসব ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের কাজ চলছে। ঢাকাবাসী আমাদের সঙ্গে আছে। তাই কোনো অঘটন ঘটলে তা মোকাবিলার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। আগামী ১৩ নভেম্বর পুলিশসহ রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সদস্য মোতায়েন থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে ককটেল বিস্ফোরণ ও ঝটিকা মিছিল নিয়ে তিনি বলেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল ১ থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এছাড়া, গত দুই দিনে রাজধানীতে ৯টি গাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। এসব ঘটনায় ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল ও তাদের অঙ্গ-সংগঠন অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য ১৪টি ঝটিকা মিছিল করেছে। ঢাকার বাইরে থেকে লোকজন ঢাকায় এসে টাকার বিনিময়ে মিছিল করে ঢাকার বাইরে চলে যায়। এসব ঘটনায় অক্টোবর থেকে ৫৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেছি, হেলমেট ও মুখোশ পরে ভোরবেলায় কিংবা ব্যস্ত সময়ে ককটেল বিস্ফোরণ করা হচ্ছে। ককটেল বিস্ফোরণ করানোর জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের ব্যবহার করা হচ্ছে।