
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক সংস্কারে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ ঘোষণার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল চলতি জুলাই মাসের মধ্যেই।
কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) মাসের শেষ দিন হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আটটি মৌলিক সংস্কার ইস্যুতে মতপার্থক্যের কারণে সনদের ঘোষণা স্থগিত করা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য তৈরির উদ্দেশ্যে গঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ এর আগে জানায়, জুলাইয়ের শেষ দিনে একটি ‘সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য খসড়া’ দলগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী আজকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফের সংলাপে বসছে কমিশন।
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, গত চার মাসে ১৯টি বৈঠকের মাধ্যমে ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য গঠিত হলেও আটটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে এখনো একমত হতে পারেনি দলগুলো। ফলে নির্ধারিত সময়ে সনদ ঘোষণা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় কমিশনের মেয়াদও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের অক্টোবরে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তারা সংস্কারের সুপারিশগুলো ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ ও ‘রাজনৈতিক মতৈক্য প্রয়োজন’—এই দুই ভাগে ভাগ করে সংলাপ শুরু করে।
এরই ধারাবাহিকতায় দুই ধাপে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে পৃথক ও সম্মিলিতভাবে সংলাপ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফার সংলাপের ২২তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গতকাল (৩০ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে।
কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে—প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদ নির্ধারণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার, সংসদীয় কমিটির কাঠামো, নির্বাচনি সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের বিধান, হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, উপজেলায় নিম্ন আদালত স্থানান্তর, জরুরি অবস্থা জারি, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, নির্বাচন কমিশনের গঠন, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা নিষিদ্ধকরণ।
অপরদিকে এখনো যেসব বিষয়ে মতৈক্য হয়নি, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—চারটি সাংবিধানিক সংস্থায় নিয়োগ, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ও সরাসরি নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, রাষ্ট্রের মূলনীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারণ।
গতকাল দ্বিতীয় দফার বৈঠকে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আলোচনা সূচিতে থাকলেও দিনের শেষ পর্যন্ত কেবল ‘সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব’ নিয়েই আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে খানিকটা অগ্রগতি হয়েছে বলে কমিশন জানালেও চূড়ান্ত ঐকমত্য গঠিত হয়নি।
বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও এনসিপির মতো রাজনৈতিক দলগুলো সনদের আইনি ভিত্তি চাচ্ছে। বিশেষ করে এনসিপি জানিয়েছে, ৩৬ জুলাইয়ের মধ্যেই সনদ ঘোষণা না হলে তারা আন্দোলনে নামবে। জামায়াত বলছে, গণভোট, আইনি কাঠামো বা রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া সম্ভব।
এ অবস্থায় ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণাকে ঘিরে জনমনে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা আপাতত আটকে পড়েছে মতপার্থক্যের জালে। তবে কমিশন আশাবাদী যে, অতিরিক্ত সময়ের মধ্যে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।