
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার (৫ জুন) মাস্কের বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা শেয়ার বাজারে ১৫২ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে। যদিও সমস্যা মিটিয়ে নিতে মাস্কের সাথে ট্রাম্প কথা বলবেন, এমন খবরে শুক্রবার (৬ জুন) টেসলার শেয়ারে ৪ শতাংশ ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা গেছে।
নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই দিয়ে আসছিলেন ট্রাম্প ও মাস্ক। তবে দীর্ঘদিনের চাঁপা ক্ষোভের বাঁধ ভেঙ্গে বৃহস্পতিবার দু’জনই একেঅন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন। মাস্ক যথারীতি সমালোচনায় মুখর হলেন ট্রাম্পের বিতর্কিত ট্যাক্স ও ব্যয় সম্পর্কিত বাজেট বিল নিয়ে।
অন্যদিকে ট্রাম্প হুমকি দিলেন মাস্কের সরকারি ভর্তুকি ও তাঁর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সকল প্রকার সরকারি চুক্তি বাতিল করার। শুধু তাই নয়, গতকাল হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে সকলের সামনে প্রকাশ্যে মাস্কের সমালোচনাও করেন ট্রাম্প। আর তাতেই টালমাটাল টেসলার শেয়ার।
দুই বন্ধুর দ্বন্দ্ব চরমে, মাস্কের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের হুমকি ট্রাম্পেরদুই বন্ধুর দ্বন্দ্ব চরমে, মাস্কের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের হুমকি ট্রাম্পের
ইলন মাস্কও দমে যাওয়ার পাত্র নন। ট্রাম্পের হুমকির প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছেন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করা উচিত। শুধু তাই নয়, ট্রাম্পকে অকৃতজ্ঞ আখ্যা দিয়ে মাস্ক বলেন, ‘আমি না থাকলে ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে যেত।’
বোঝাই যাচ্ছে, দু’জনের মধ্যে মাস ছয় আগের সেই ‘ব্রোমান্স’ এখন আর অবশিষ্ট নেই। দু’জনের দুটি পথ এখনও পুরোপুরি আলাদা না হলেও পূর্বের ন্যায় এক হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার রাজনীতিতে মানিক-জোর এই জুটির মাঝে এমন ঘোরতর দ্বন্দ্ব তৈরি হলো কীভাবে? এর পেছনে কারণই বা কী?
রাজনীতিতে নতুন সম্পর্ক যেমন তৈরি হয় স্বার্থের জোরে তেমনি সম্পর্কচ্ছেদও হয় স্বার্থহানি হলে। ট্রাম্প-মাস্ক সম্পর্কও প্রচলিত ‘রাজনৈতিক বন্ধুত্বের’ ব্যতিক্রম নয় একেবারেই। বিশেষ করে দু’জনের মূল পরিচয় যখন ব্যবসায়ি তখন স্বার্থের দ্বন্দ্বটাও যে ব্যবসায়িক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অর্থকরী হচ্ছে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান টেসলা। কিন্তু চলতি বছর এখন (৫ জুন) পর্যন্ত টেসলার শেয়ারে দরপতন হয়েছে ২৯.৫ শতাংশ। এর মধ্যে বৃহস্পতিবারই তাঁদের বাজারমূল্য হ্রাস পেয়েছে ১৪ শতাংশ।
অথচ গত নভেম্বরে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার খবরে উল্কার গতিতে বেড়েছে টেসলার শেয়ারদর এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির বাজারমূল্য ১ ট্রিলিয়ন ডলারও ছাড়িয়ে যায় (বর্তমানে এই প্রতিবেদন তৈরির সময় টেসলার বাজারমূল্য ৯২৪.৮১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
টেসলার খারাপ পারফরম্যান্সের পেছনে মূল কারণ কী?
টেসলার অপ্রত্যাশিত খারাপ পারফরম্যান্সের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। ট্রাম্প সরকারে ব্যয় সংকোচন বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি বা ডোগ) প্রধান হিসেবে কর্মরত অবস্থায় মাস্কের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ২ লাখ ৮৪ হাজারেরও বেশি কর্মী ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন সরকারের বিভিন্ন বিভাগে (স্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক মিলিয়ে)।
ফলে বিশাল সংখ্যক আমেরিকানের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন মাস্ক। বিগত ৫ মাসে তাঁর পাবলিক ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহুলাংশে। সার্বিকভাবে ডোগের প্রধান হিসেবে তিনি যতটা সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়েছেন তা বোধহয় এর আগে কখনও হননি।
ব্যক্তি ট্রাম্পের ইমেজ সঙ্কটের নেতিবাচক প্রভাবে টেসলার জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েছে। অনেকেই মাস্কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরুপ টেসলার তৈরি গাড়ি বর্জনের ডাক দিয়েছেন। এমনকি অনেকে নিজের মালিকানাধীন টেসলা গাড়ি বিক্রিও করে দিয়েছেন। তবে টেসলার পড়তি চাহিদার পেছনে এর চেয়েও বড় কারণ চীনের বাজারে তাঁদের বিক্রি উদ্বেগজনক হারে কমে যাওয়া।
চীনের বাজারে টেসলার পারফর্মেন্স
চলতি বছর প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ সময়ে চীনের বাজারে (রপ্তানিসহ) ১ লাখ ৭২ হাজারেরও বেশি (১,৭২,৭৫৪) বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি করেছে টেসলা। সংখ্যাটা গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। এমনকি পূর্ববর্তী প্রান্তিকের (অক্টোবর-নভেম্বর, ২০২৪) তুলনায়ও ২৮ দশমিক ২৯ শতাংশ কম।
এখানেই শেষ নয়। গত মাসেও (মে) চীনে তৈরি টেসলার বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। সাংহাইতে অবস্থিত টেসলার গিগাফ্যাক্টরি’তে তৈরি মডেল ৩ (থ্রি) ও মডেল ওয়াই’র বিক্রি (আভ্যন্তরীণ বিক্রি ও রপ্তানি) গত বছরের মে মাসের তুলনায় ১৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৬৬২ ইউনিটে।
চায়না প্যাসেঞ্জার কার অ্যাসোসিয়েশন বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলেও চীনে টেসলার বিক্রি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যদিও এ বছর এপ্রিলের তুলনায় মে’তে বিক্রি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডি এগিয়ে যাচ্ছে
বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে টেসলার বৈশ্বিক বিক্রি যখন কমছে তখন তাঁদের চীনা প্রতিদ্বন্দ্বী বিওয়াইডি’র বিক্রি বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে টেসলার বৈশ্বিক বিক্রি হ্রাস পেয়েছে ১৩ শতাংশ। অথচ একই সময়ে বিওয়াইডি’র বিক্রি বেড়েছে ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
২০২৪ সালে বিওয়াইডি সারা বিশ্বে ৪২ লাখ গাড়ি বিক্রি করেছে, যেটা ২০২৩ এর তুলনায় ৪১ শতাংশ বেশি। একই বছর (২০২৪) টেসলা বিশ্বজুড়ে ১৭ লাখ ৯০ হাজার গাড়ি বিক্রি করতে সক্ষম হয়, যেটা আগের বছরের (২০২৩) তুলনায় ১ শতাংশ কম! আর তাই গত বছর বৈদ্যুতিক গাড়ির বৈশ্বিক বাজারে টেসলার শেয়ার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ (২০২৩ সালে) থেকে ৬ শতাংশে নেমে আসে।
টেসলা’র চীন-নির্ভরশীলতা বাড়ছে
টেসলার জন্য চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর (২০২৪ সালে) চীনে টেসলার বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৮ শতাংশ, যেখানে তাঁদের বৈশ্বিক বিক্রি হ্রাস পেয়েছে ১ শতাংশ।
এমনকি এ বছর প্রথম প্রান্তিকে চীনের বাজারে টেসলার বিক্রি হ্রাস পেলেও সংখ্যাটা তাঁদের বৈশ্বিক মোট বিক্রির ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ, জানুয়ারি-মার্চ সময়ে টেসলার মোট বৈশ্বিক বিক্রিতে চীনের অবদান ৪০ শতাংশ।
গত বছর সারা বিশ্বে টেসলার বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে ১৭ লাখ ৯০ হাজার ইউনিট, যার মধ্যে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশই হয়েছে চীনে। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে চীনের ওপর টেসলার নির্ভরশীলতা আরও কিছুটা বেড়েছে।
টেসলার চীন-নির্ভরশীলতার আরও একটি দিক হচ্ছে সাংহাই’তে অবস্থিত তাঁদের গিগাফ্যাক্টরি- যেখানে উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়ি চীনের আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা হয় ইউরোপসহ অন্যান্য দেশেও।
উল্লেখ্য, গত বছর বিওয়াইডি’র মোট বৈশ্বিক বিক্রির ৯০ শতাংশই হয়েছে চীনের বাজারে। অর্থাৎ, চীনের বাজারের ওপর টেসলার চেয়েও অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল বিওয়াইডি। আর এ কারণেই চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রীতিমতো মূল্য যুদ্ধ (প্রাইস ওয়ার) চলছে। কেননা সকলেই চাইছে চীনের বাজারে নিজেদের শেয়ার আরও কিছুটা বৃদ্ধি করতে।
ট্রাম্প-মাস্ক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে কি তবে চীন?
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক (রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ) ঘোষণার প্রেক্ষাপটে চীন-মার্কিন শুল্ক যুদ্ধের সূচনা হয়েছে গত এপ্রিলে। একেঅন্যের ওপর দেশ দুটি পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপের খেলায় মেতে উঠলে অস্থিতিশীল হয়ে উঠে বিশ্ব অর্থনীতি। সার্বিকভাবে, বাইডেন সরকারের শেষ দিনটিতে চীন ও আমেরিকার মধ্যে যে সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল তা ট্রাম্পের অধীনে বিগত ৪-৫ মাসে আরও খারাপ হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই, চীন-মার্কিন শুল্কযুদ্ধ প্রকট হলে তাঁর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে টেসলার ওপরেও। আমেরিকার বাজারে চীনা পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক দিতে হলে, সে শুল্কের আঁচ যে টেসলাও অনুভব করবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ট্রাম্প যদি ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে এগোয় তাহলে চীনই-বা কেন টেসলার প্রতিদ্বন্দ্বী বিওয়াইডি’র মতো স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কিছু অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করবে না? একইভাবে, ট্রাম্প যদি চীনা প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক শুল্কারোপের পথে হাঁটেন তাহলে শি জিনপিং-ই বা কেন বসে থাকবেন!
পাল্টা শুল্কারোপের ভবিতব্য যে এমন হতে পারে তা বেশ ভালোই অনুধাবন করতে পারছেন ইলন মাস্ক। শুধু তাই নয়, ট্রাম্পের ঘোষিত সাম্প্রতিক ব্যয় সক্রান্ত বাজেট বিলে বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর ৭৫০০ ডলার কর ছাড়ের সুবিধাটি তুলে নেওয়ার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। চীনের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে যতটা সম্ভব কম দামে বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তখন আমেরিকায় ৭৫০০ ডলারের কর সুবিধাটি বন্ধ করা হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানটির নাম যে হবে টেসলা তা-ও বেশ অনুমান করা যায়।
সার্বিকভাবে, ট্রাম্প ও মাস্কের মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্বে টেসলার পড়তি বাজার অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে চীন-আমেরিকা সম্পর্কের অবনতি মূল ইস্যু হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই এক কথায়, চীন-মার্কিন শুল্কযুদ্ধ তথা সম্পর্কের টানাপোড়েনকে ট্রাম্প-মাস্ক ব্রোমান্সের মূল হন্তারক বললে, বোধ করি খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না।