
হাসান তাহের ইমাম, ছবি: সংগৃহীত
দেশের শেয়ারাবাজার থেকে ৭শ কোটি টাকা লুট করে লাপাত্তা রয়েছেন ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হাসান তাহের ইমাম। তার বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও নেয়া হচ্ছে না ব্যবস্থা।
হাসান তাহের ইমাম এসব অপকর্ম নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার ভাতিজা সাবিরুলকে (সাবির) ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজার লুট করে পাচার করা হয়েছে শতকোটি টাকা। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করে হাসান তাহের ইমাম দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন স্ত্রী-সন্তানদের নামে অবৈধ সম্পদ।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির সম্মুখীন করতে হাসান তাহের ইমাম বিভিন্ন ধরনের ছকে করেছেন প্রতারণা। নিজের নিয়ন্ত্রিত ব্রোকারেজ হাউজ মাল্টি সিকিউরিটিজকে ব্যবহার করে অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন শত শত কোটি টাকা। ব্যবহার করেছেন নিজস্ব ব্যক্তিস্বার্থের বেশ কিছু কোম্পানির অ্যাকাউন্টও। তার মধ্যে রিট করপোরেশন, ভাইকিংস, টার্ন বিল্ডার্স, বিডি এসএমই করপোরেশন, একাসিয়া ফান্ডস, ইনভেস্ট এশিয়া ক্যাপের মতো অ্যাকাউন্টগুলো অন্যতম।
উল্লিখিত এসব সিকিউরিটিজের মাধ্যমে জালিয়াতি করে বিনিয়োগকারীদের কষ্টার্জিত শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে তথ্য উঠে এসেছে সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুটপাট ও ফায়দা হাসিলের জন্য তিনি বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির (বিজিআইসি) বোর্ডে থাকা তিন ব্যক্তিকে ব্যবহার করেছেন। নিজের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বড় বোনকেও বিজিআইসিতে অন্তর্ভুক্ত করেন হাসান ইমাম। লোপাটের টাকায় নিজের ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে দেশে-বিদেশে শতকোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, হাসান তাহের ইমাম এই অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণ করে ভাগিয়ে নেয়া টাকায়।
৭শ কোটি টাকার অনৈতিক লেনদেন
হাসান তাহের ইমামের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর পল্টন মডেল থানায় শতকোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ করেন মো. রুহুল আমিন আকন্দ নামে একজন বিনিয়োগকারী।
অভিযোগে বলা হয়, ছলচাতুরী ও অন্যায়-অনিয়মের মাধ্যমে হাসান তাহের ইমাম ১২টি মিউচুয়াল ফান্ড এবং একটি এসপিভি কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৩শ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে রুহুল আমিনের ব্যক্তিগত তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে তার নিয়ন্ত্রিত ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের থেকে বেশি হারে কমিশন নিয়েছেন। শুধু ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিনিয়োগকারীদের থেকে ব্রোকারেজ হাউজের লেনদেন কমিশন বাবদ ৫০-৬০ কোটি টাকা বেশি নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হাসান ইমাম পাবলিক ফান্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং তার নিজস্ব কোম্পানি, সংস্থা ও তহবিলের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন। মাত্র পাঁচ বছরে অনৈতিক ও আইনবহির্ভূতভাবে লেনদেন করে তিনি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ৭শ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত করে আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া মাল্টি সিকিউরিটিজকে ব্যবহার করে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশ কিছু কোম্পানির অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণ অর্থ জালিয়াতি করেছেন।
অনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য হাসান তাহের ইমামের বড় বোন এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তিকে বিজিআইসির বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করেন। বিভিন্নভাবে মিউচুয়াল ফান্ডের রুলস ও আইন লঙ্ঘন করে সুবিধা নিয়েছেন। নিজের অনিয়ম ঢাকতে হাসান ইমাম মাল্টি সিকিউরিটিজের সফটওয়্যার ধ্বংস করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে ট্রেডসংক্রান্ত তথ্য সিডিবিএল, ডিএসই, সিএসই ও বিএসইসির নজরদারিতে সংরক্ষিত রয়েছে। তদন্তে চিহ্নিত তার প্রধান ট্রেড জালিয়াতির কৌশল হিসেবে হাসান ইমাম জনসাধারণের তহবিল অপব্যবহার করে তার নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোর জন্য অবৈধ মুনাফা অর্জন করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনসাধারণের তহবিল ব্যবহার করে ট্রাস্টি বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং সেটিকে অবৈধ লেনদেনে ব্যবহার করেন। ডিএসই ও সিএসই প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে বড় ব্লক ট্রেড জটিল করে তোলেন। মূল্য বিকৃতি করে অবৈধ আয় এবং জনস্বার্থ নষ্ট করেন। জনসাধারণের তহবিল থেকে অস্বাভাবিক কমিশন আদায় করে সেগুলো নগদ অর্থে তুলে নেয়। সিআইডির তদন্তে এই প্রতারণামূলক কার্যকলাপ উন্মোচিত হয়েছে। সিআইডির দেয়া অনুসন্ধান ও তদন্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ১৮৬০-এর আওতায় কোড নং ১০৯, ৪০৮, ৮২০, ৫০৬, ৪৬৭, ৪৬৮ ধারায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হলেও পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সহায়তায় তার ভাতিজা সাবিরুলকে নিয়োগ দিয়ে তদন্তে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেন এবং সবকিছু স্থবির করে দেয়ারও অভিযোগ ওঠে হাসান ইমামের বিরুদ্ধে। ফলে এখন পর্যন্ত হাসান ইমামের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি।
বিএসইসির পদক্ষেপ
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২০২৩ সালে কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে হাসান ইমামের বিরুদ্ধে অর্থপাচারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ২০২৪ সালে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। তদন্ত চলাকালীন ফান্ড থেকে টাকা সরিয়ে নেয়ার কোনো সুযোগ যেন না থাকে, সে লক্ষ্যে বিএসইসির পক্ষ থেকে তার ফান্ডগুলোর সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার জন্য বিএফআইইউকে চিঠি দেয়া হয়।
ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১০ জুন বিএফআইইউ ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দেয়। একই সাথে ওই বছরের ২৫ জুন সব ফান্ডের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবের লেনদেন স্থগিত করে দেয় বিএসইসি। তবে এই তদন্ত কমিটি গঠনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
দুদকের অনুসন্ধান
হাসান ইমামের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের কয়েকশ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকে। লুটপাট করা অর্থে তিনি বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে সংস্থাটির কাছে অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে দুদক তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র চেয়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি দফতরে চিঠিও দিয়েছে সংস্থাটি।
দুদকে দায়েরকৃত অভিযোগে বলা হয়েছে, হাসান ইমামের বিরুদ্ধে তার ব্রোকারেজ হাউজে বিনিয়োগকারীদের কয়েকশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নিজের ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে দেশে-বিদেশে সম্পদের মালিকানা রয়েছে এমন অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির সহকারী পরিচালক আফিয়া খাতুনকে নিয়োগ দেন।
তিনি অনুসন্ধানের স্বার্থে হাসান তাহের ইমাম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ব্যাংক-বীমা, সিটি করপোরেশন, ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসসহ বিভিন্ন দফতরে চিঠি দিয়েছেন। গত বছরের ৭ মে এসব চিঠি পাঠানো হয়। তবে সব দফতর থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র এখনো দুদকে এসে পৌঁছায়নি। ফলে আটকে আছে অনুসন্ধান কাজও।
এদিকে, হাসান তাহের ইমাম ও তার পরিবারের নামে ঢাকায় কয়েকটি বাড়ি ও প্লট থাকার প্রমাণ দুদকের কাছে রয়েছে। এসব বাড়ির মধ্যে ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানী ৪ নম্বর রোডের ৬৫ নম্বর প্লট, একই এলাকার জি-ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ২১ নম্বর প্লট এবং উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোডের ৪৬ নম্বর বাড়ি। এ ছাড়া ঢাকার একটি আবাসিক প্রকল্পে তার বেশ কয়েকটি প্লট রয়েছে। এসব বাড়ি ও প্লটের মালিক হিসেবে কাদের নাম রয়েছে তাও জানাতে চিঠি দেয়া হয়েছে।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজার ধ্বংসের জন্য যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দায়ী তাদের এখনো আইনের আওতায় আনা হয়নি। দেশের শেয়ারবাজারে আর যাতে কোনো অপরাধী আসতে না পারে এ জন্য সব অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের অপরাধ করতে সাহস পাবে না।