চাঁপাইনবাবগঞ্জে অগ্রনী সেচ প্রকল্পের সদ্য সমাপ্ত ত্রি-বার্ষিক নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত ও পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে জেলা সমবায় অফিসারের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বি কয়েকজন প্রার্থী। মৃত ও প্রবাসী ভোটার এবং ভুয়া ঠিকানাধারী ২১৩ টি অবৈধ ভোট বাতিলসহ গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কার্যক্রমের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ ডিসেম্বরে অগ্রণী সেচ প্রকল্পের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ভোট গ্রহণের সময় একটি প্যানেলের সভাপতি পদপ্রার্থী সাইফুল ইসলাম গাজী, সাধারণ সম্পাদক-এনামুল হক, সহ-সভাপতি-তোফাজ্জল হোসেন ও সদস্য প্রার্থী একেএম মেরাজুল ইসলামের পক্ষে ‘গনকা’ ভোট কেন্দ্রে অবৈধভাবে রাসেল নামে একজনকে পাঠানো হয়। সে ভোট প্রদান করার সময় হাতে নাতে ধরে প্রশাসেনর কাছে সোর্পদ করা হয়। এ সময় রাসেল স্বীকার করে ওই চারজন প্রার্থীদের পক্ষে তিনি অবৈধ ভোট প্রদান করেছেন।
একইভাবে ৬টি ব্লকের ১২টি বুথে অনুপস্থিত ভোটারদের হয়ে অবৈধভাবে প্রায় ২১৩টি ভোট প্রদানের অভিযোগ পাওয় যায়। এ সময় ভোট প্রদান বন্ধ রাখতে বলা হলেও; ভোট প্রদান বন্ধ না করে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করেন নির্বাচন কমিশন। এ অবস্থায় ভোট বাতিলসহ পুনরায় ভোট গ্রহনের দাবিতে জেলা সমবায় অফিসারের কাছে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
এ বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বি সভাপতি প্রার্থী ও অভিযোগ দায়েরকারী মাহফুজ হোসেন জানান,‘ সেচ প্রকল্পের ৬ টি ব্লকের ১২টি বুথে মোট ২১৩ জন ভুয়া ঠিকানাধারী, মৃত ও প্রবাসী ভোটারদের ভোট অবৈধভাবে অন্যকে দিয়ে প্রতিপক্ষ প্যানেল ভোট প্রদান করেন। যাদের আমরা নির্বাচন পরবর্তীতে শনাক্ত করেছি এবং গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন পরবর্তী একমাসের মধ্যে আবেদন করার নিয়ম থাকায় জেলা সমবায় অফিসারের কাছে বিভিন্ন অনিয়ম ও ভোট জালিয়াতি এবং কারচুপির বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করি এবং দাবি জানায় নির্বাচন বাতিল ও পুনরায় ভোট গ্রহণের।
তিনি অভিযোগে আরও জানান, ‘গঠনতন্ত্রের ১৩-চ’ ধারা অনুযায়ী সকাল ৯ টা থেকে ১টা পর্যন্ত বার্ষিক সাধারণ সভা এবং ১ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত নির্বাচনের ভোট গ্রহন করার নির্দেশনা উল্লেখ থাকলেও; গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহন করেন সমিতির নির্বাচন পরিচালনাকারী সভাপতি ও উপজেলা সমবায় অফিসার শফিকুল ইসলাম। আর এ অনিয়মের কারনে এজিএমের সদস্যরা এজিএমে ব্যস্ত থাকায় ভোট গ্রহণ বুথগুলোতে ভুয়া, মৃত, প্রবাসী ও ভুয়া ঠিকানাধারী ভোটারদের ভোট অন্যরা দেওয়ার সুযোগ নেয়।’
প্রতিদ্বন্দ্বী সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ও অভিযোগ দায়েরকারী অপর প্রার্থী হাবিবুর রহমান পিন্টু জানান, গঠনতন্ত্রের ১২-ক’ ধারায় (সমবায় আইন সংশোধিত ২০১৩ ও বিধিমালা অনুযায়ী) এলজিইডি ও সমবায় অফিসারের উপস্থিতিতে ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্ব হস্তান্তরের নিয়ম থাকলেও; সেখানে এই দুইজন কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি আবুল কালাম শামসুদ্দিন শরীফ নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন। গঠনতন্ত্রের ১৩(১) ক-ধারা অনুযায়ী বার্ষিক সাধারণ সভা আহ্বানের ১৫দিন আগে সদস্যদের নোটিশ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও; তা দেওয়া হয়নি।’
এদিকে, নির্বাচনের পূবেই নির্বাচনকালীন সভাপতি ও উপজেলা সমবায় অফিসার শফিকুল ইসলামের সাথে সাইফুল ইসলাম গাজী ও এনামুল হক প্যানেলের সখ্যতা ও বিভিন্ন কার্যক্রমে তার ভূমিকা সন্দেহজনক হওয়ায় সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে, প্রতিদ্বন্দ্বি সভাপতি পদপ্রার্থী মাহফুজ হোসেন ও হাবিবুর রহমান পিন্টু উপজেলা সমবায় অফিসারের অপসারণ ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ চেয়ে জেলা সমবায় অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও; তাকে দিয়েই নির্বাচন পরিচালনা করা হয়।
এদিকে আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে ভোটার নং ৫৪৬ (সাদিকুল ইসলাম), ভোটার নং ৪৫৫ (আব্দুল গণি) ও ভোটার নং ২৬০৭ (রোজিনা খাতুন) তারা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান করতে পারেনি বলে লিখিত অভিযোগ করেন জেলা সমবায় অফিসারের কাছে। তারা অভিযোগ করেন চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় তাদের নাম থাকলেও; ভোট কেন্দ্রের ভেতরের তালিকায় তাদের নাম না থাকায় তারা ভোট দিতে পারেননি।
এদিকে, অনুসন্ধানে আরো জানাগেছে ভোটের দিন ব্যালট পেপারে পোলিং ও প্রিসাইডিং অফিসারের সাক্ষর ও গোপন সীল ছিলনা। এমনকি ভোটের দিন ভোট গণণা শেষে প্রার্থীদের এজেন্টদের রেজাল্ট শীটে কোন সাক্ষর নেওয়া হয়নি এবং রেজাল্টশীটও দেওয়া হয়নি; এমনকি সমিতির অফিসের নোটিশ বোর্ডে ফলাফল সীট টাঙ্গানো হয়নি; এবং উপজেলা ও জেলা সমবায় অফিসারের কাছে রেজাল্টশীটের কপি চাওয়া হলেও; তারা দিতে পারেনি বলে অভিযোগ করেন প্রতিদ্বন্দ্বি সভাপতি পদপ্রার্থী মাহফুজ হোসেন ও একাধিক সদস্য ভোটার।
এ অবস্থায় নির্বাচনের সকল ব্যবহৃত ও অব্যবহৃত ব্যালট পেপার, ব্যালটের মুড়ি, ভোটার তালিকায় পোলিং অফিসারদের সাক্ষর ও লাল কালি দিয়ে টিপ মারা কপি সংরক্ষণ ও ব্যালট বক্সসহ নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার কাগজপত্র সরকারি হেফাজতে রক্ষনাবেক্ষণে জেলা সমবায় অফিসারের কাছে লিখিত আবেদন দেওয়া হলেও; এখন পর্যন্ত তা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। যা নতুন ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছেই সংরক্ষিত থাকায় উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা।
সেচ প্রকল্পের একাধিক সদস্য এবং প্রতিদ্বন্দ্বি পদপ্রার্থীরা অভিযোগ কওে বলেন; সাবেক ব্যবস্থাপনা কমিটির অনিয়ম দূর্নীতি ঢাকতেই নির্বাচন পরিচালনা কমিটি, উপজেলা ও জেলা সমবায় অফিসার এসব অভিযোগ আমলে না নিয়েই ভোট পরিচালনা করেন।
এদিকে নির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগে অভিযুক্ত প্যানেলের সভাপতি সাইফুল ইসলাম গাজী ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক জানান; অনেক ভোটে ফেল করে ভিত্তিহীন এসব অভিযোগ আনছেন তারা। আমরা নির্বাচন পরবর্তীতে দায়িত্ব গ্রহণ শেষে ব্যাংক সাক্ষর পরিবর্তন ও সদস্যদের মধ্যে ঋণ প্রদানও অব্যাহত রেখেছি।’
তবে দায়িত্ব হস্তান্তরে উপস্থিত না থাকার কারন সর্ম্পকে উপজেলা সমবায় অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান, দায়িত্ব হস্তান্তরে উপস্থিত থাকতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা আমাদের নেই।
এদিকে জেলা সমবায় অফিসার আকরাম হোসেনের কাছে এসব অনিয়ম ও নির্বাচনে জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের একাধিক লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে শুনানি কার্যক্রম শুরু করেছি। শুনানি শেষে এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, জানাগেছে অগ্রণী সেচ প্রকল্পের মোট ভোটার অডিট অনুসারে ২১৩৭; যদিও তফসিল অনুসারে তা ২১০৩ জন। আর এই প্রকল্পের সদস্যদের স য়ের পরিমান প্রায় ছয়কোটি টাকা। সমবায় আইন (সংশোধিত) ২০১৩ বিধিমালা অনুযায়ী এফডিআরের নিয়ম না থাকলেও; নির্বাচনের আগে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ইসলামি ব্যাংকে ১১ লাখ ৭৫হাজার টাকার এফডিআর দেখিয়েছেন গত কমিটি; এমন আপত্তির অভিযোগও করেন নিরীক্ষা কমিটি।