মোবারকের ওপর আস্থা রেখে ইয়ুথ গ্রুপের অফিসেই জমি রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করা হয়। কমিশন দিয়ে রূপগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে কর্মকর্তাদের নিয়ে এসেছেন বলে জানান মোবারক। তাঁরা জমিদাতাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি সংগ্রহ, টিপ সই ও স্বাক্ষর নিয়ে নিবন্ধনের সব কাজ শেষ করেন। পরে সেই জমির নামজারির দায়িত্বও নেন মোবারক। জমির নিবন্ধন ও নামজারির সব নথিপত্রও সরবরাহ করেন তিনি।
ছয় বছর পরে ওই জমিতে গিয়ে জানা যায়, আকবর হায়দাররা যেসব জমি কিনেছেন, সেগুলোর প্রকৃত মালিক জমি বিক্রি করেননি। রাজউক ও ভূমি অফিসেও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁদের কেনা জমির নামজারি হয়নি। তাঁরা যাঁদের কাছ থেকে জমি কিনেছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন সাজানো মালিক। তাঁদের এনআইডি ও ছবি সবই ছিল ভুয়া। জমি কেনার যেসব নথি মোবারক সরবরাহ করেছিলেন, সেগুলো তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পূর্বাচলের বিভিন্ন প্লটের বরাদ্দপত্র, অফিস আদেশ, মালিকানা সনদ, বিক্রির অনুমতিপত্রসহ সব নথি নিজেই তৈরি করতেন মোবারক ও তাঁর সহযোগীরা। নথিগুলো দেখে কেউ বুঝতেই পারবেন না, সেগুলো নকল। মোবারকের ফাঁদে পা দিয়ে জমির ক্রেতারা রাজউকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ না নিয়ে বিপুল অর্থ খুইয়েছেন।
সরেজমিনে যা জানা গেল
সম্প্রতি ইছাপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ইছাপুর মধ্যবাজার জামে মসজিদ সংলগ্ন বালু নদীর পাড়ে ১৭ শতাংশ জমিতে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবন মালিক মুক্তা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে, আর তাঁর স্বামী মোবারক ভারতে পালিয়ে গেলেও ভবন নির্মাণকাজ থেমে নেই। নির্মাণাধীন ১০তলা ভবনটির ৮তলার অবকাঠামো উঠে গেছে। কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিককে সেখানে কাজ করতেও দেখা যায়। বিল্লাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি ভবন নির্মাণের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন।
মোবারকের এক প্রতিবেশী বলেন, হঠাৎ করে মোবারক এত সম্পদের মালিক হওয়া নিয়ে এলাকায় আলোচনা ছিল। কেউ বুঝতে পারছিলেন না এই অল্প সময়ে কীভাবে তিনি এত অর্থ–বিত্তের মালিক হলেন।
রূপগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, ইছাপুর এলাকায় মোবারকই প্রথম ১০তলা ভবন নির্মাণ করছেন। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করছিলেন তিনি। এলাকায় কোনো অনুষ্ঠান হলে সেখানেও অর্থ সহায়তা দিতেন মোবারক।
স্থানীয় পুলিশ জানায়, মোবারক রেস্তোরাঁ ব্যবসার আড়ালে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছিলেন। হোয়াইট হাউস নামের ওই রেস্তোরাঁয় গত বছরের ১৮ জুন ভোরে অভিযান চালিয়ে মাদক, জুয়া ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযানে দেশি-বিদেশি মদ, বিয়ার, জুয়া খেলার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। তখন সেটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।
রাজউক কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা
সরেজমিনে ইছাপুর এলাকায় জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতাকারী তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, ওবায়দুল্লাহ রাজউকের অফিস সহকারী। ইছাপুর এলাকায় যাঁরা জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা করেন, তাঁদের সবার সঙ্গেই ওবায়দুল্লাহর সখ্য আছে। তাঁরা তাঁকে ‘ওবায়দুল কাকা’ সম্বোধন করেন। পূর্বাচলের কোনো প্লটের নথির প্রয়োজন হলে প্রায় সবাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্লট কেনাবেচায় মধ্যস্থতার পাশাপাশি নিজেও এই ব্যবসা করেন ওবায়দুল্লাহ।
ওবায়দুল্লাহর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ইয়ুথ গ্রুপের উপপরিচালক জয় মিত্র বলেন, প্লট কেনাবেচার সময় কয়েকবার ওবায়দুল্লাহকে ইয়ুথ গ্রুপের অফিসে নিয়ে এসেছিলেন মোবারক। তখন তাঁকে রাজউকের কর্মকর্তা বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বিভিন্ন নথি দেখে ঠিক আছে বলে জানিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে ওবায়দুল্লাহ বলেন, মোবারকের সঙ্গে তাঁর একসময় পরিচয় ছিল। তবে চার-পাঁচ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। একটি জমি কেনার সময় ইয়ুথ গ্রুপের লোকজন তাঁর অফিসে এসেছিলেন। তবে তিনি কখনো ইয়ুথ গ্রুপের অফিসে যাননি। তিনি কখনো প্লট কেনাবেচায় যুক্ত ছিলেন না। মোবারক তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আর রূপগঞ্জের জমির মধ্যস্থতাকারীরা ভুল তথ্য দিয়েছেন।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, মোবারক পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করা গেলে নথিপত্র কীভাবে জাল করেছেন, কাদের ভুয়া মালিক সাজিয়েছেন, সব কিছু জানা যাবে। সূত্র: প্রথম আলো