
ইদানিং না বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। এই তো বেশ আছি অফিস, বাসা, ছোট্ট ছেলে, টুকটাক রান্না, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কয়েকদিন না দেখলেই বাবা আমার ফোনে অভিমান মাখা স্বরে বলে, বাড়ির রাস্তা কি ভুলে গেলে? কতদিন দেখি না । আমার আর বলা হয়ে উঠে না কেন বাড়ি যাই না। মা আমার চিরকালই চাপা। নিজের দুঃখের কষ্টের কথা কখনোই প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু আমি বাড়ি থেকে চলে আসার মুহূর্তে কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, দুই চোখ বেয়ে জল ঝরবেই। ঠিক এই চেহারাটাই বাড়ি থেকে আসার পর কিছুতেই ভুলতে পারি না। খাবার দাবার বিস্বাদ লাগে, শুধু মনে হয় এই কয়েকদিন কি খেয়েছি আর এখন কি খাচ্ছি! মনটা হাহাকার করতে থাকে। আমি ঠিক বুঝতে পারি, মাও ঠিক এই রকম হা হুতাশ করছেন। এজন্যই বাড়ি যেতে ইচ্ছে হলেও অনেক সময় নিজেকে সম্বরণ করি।
মায়ের আমার ওষুধ ছাড়া কিছুতেই ঘুম হতে চায় না আর সেই ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় কিনা জানি না, এক কথা অনেক বার বলে, সব সময় নয়, মাঝে মাঝে। আমার বিরক্ত লাগে, ঠিক তখন মনে পড়ে আমি ছোট থাকতে খুব কথা বলতাম আর যেটা করতাম সেটা হলো প্রশ্ন। এটা কেন হলো? এটা কেন করলে? নানা রকম প্রশ্ন। যৌথ পরিবারে অনেক লোকজন, অনেক কাজ, তার মধ্যেও আমার কথায় মা একটুও বিরক্ত হতো না, আমার প্রশ্নের উত্তর দিত ঠিক ঠাক আর এখন আমার কিনা কত অল্পতেই বিরক্তি আসে!
সেদিন হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল, আমার আইপিএস চালু হলো তখন মনে পড়লো আমাদের বাড়িতে পল্লী বিদ্যুৎ ছিল। বিদ্যুৎ যায় কিন্তু আসার নাম থাকে না। এমন বিদ্যুৎ চলে গেলে আমি ঘুমের মধ্যে ছটফট করতাম আর আমার জাদুর পরী, আমার মা তাল পাখা হাতে চলে আসতো আমার পাশে। বাতাস করতে করতে সারাদিনের কর্মক্লান্ত মায়ের হাত থেকে পাখা পড়ে যেত আর আমি তখনই উশখুশ করে উঠতাম আর ওমনি আবার হাত চলতে থাকতো, যেন ম্যাজিক।
আমি অসুস্থ হলে মাকে বলতে চাই না। আব্বার দীর্ঘদিনের ওষুধের ব্যবসা, তাই অসুখ বিসুখ তার সাথেই শেয়ার করি। কিন্তু কোনভাবে মা জানতে পারলে সারাদিন একা একাই বলতে থাকবে- না জানি মেয়েটা এখন কেমন আছে, একা একা থাকে, আল্লাহ ভালো করে দাও এসব বলবে আর আমাকে ফোন করতে থাকবে। আব্বা অনেক সময় বিরক্ত হয়ে যায়, এক কথা বার বার কেন বলো? সে তো এখন ঠিক আছে, এতো চিন্তা করো কেন? তবুও মা বিড় বিড় করবে আর জায়নামায ভেজাবে। বাড়ি গেলেই চোখটাকে অনুবিক্ষণ যন্ত্র করে আমাকে দেখে বলবে, ডায়েট করছিস? ভাত মোটেও খাস না? শুকায়ে গলার হাড় বের হয়ে গেছে!! হতভম্ভ আমি আয়নায় হাজার খুঁটে খুঁটে দেখেও কোথায় শুকালাম বুঝতে পারি না!!
এই হলো মা, অযথা চিন্তা করবে, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সন্তানের মঙ্গল চিন্তায় নিমগ্ন থাকবে। পৃথিবীর সব মায়েরাই এমন, তাঁরা সন্তানের কাছে বেশি কিছু চান না, একটু সময় চান, একটু মনোযোগ কামনা করেন। কিন্তু জীবন জীবিকার প্রতিযোগিতায় আমরা এমন দৌড়ের উপর থাকি যে মায়েদের এই ভালোবাসাকে বিরক্তি মনে করি, অনেকে তো মায়েদের এই ভালোবাসা অগ্রাহ্য করে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। আবার অনেক মা নিতান্ত অবহেলায় ঘরের এক কোণে জীর্ণ আসবারের মতো পড়ে থাকে। এখন দেখি পিতা মাতার প্রতি কর্তব্য নিয়ে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো কি বলে। “আর তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। যদি পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তুমি তাদেরকে ‘উফ’ শব্দটি পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না বরং তাদের সাথে বিনম্রভাবে সম্মাসূচক কথা বল। আর তাদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত কর। আর দোয়া কর, হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি রহমতের আচরণ করুন, যেভাবে তাঁরা শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন (সূরা বনী ঈসরাইল আয়াত: ২৩-২৪) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তার নাক ধূলায় মলিন হোক (৩ বার) সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেই হতভাগ্য ব্যক্তিটি কে?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, সে হলো ঐ ব্যক্তি, যে তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তাদের সেবা করে জান্নাত হাছিল করতে পারলো না” (মুসলিম-৪/১৯৭৮, হা-২৫৫১)।
সনাতন ধর্মে সুন্দর একটি শ্লোকে উল্লেখ আছে: “স্ববংশবৃদ্ধিকামঃ পুত্রমেকমাসাদ্য..”। আবার সন্তান লাভের পর নারী তাঁর রমণীমূর্তি পরিত্যাগ করে মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অধ্যক্ষতা করবেন। তাই মনু সন্তান প্রসবিনী মাকে গৃহলক্ষ্মী সম্মানে অভিহিত করেছেন। তিনি মাতৃ-গৌরবের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন এভাবে- “উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচায্যাণাং শতং পিতা। সহস্রন্তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে” (মনু,২/১৪৫) অর্থাৎ দশজন উপাধ্যায় (ব্রাহ্মণ) অপেক্ষা একজন ‘আচার্যের গৌরব অধিক, একশত আচার্যের গৌরব অপেক্ষা পিতার গৌরব অধিকতর; সর্বোপরি, সহস্য পিতা অপেক্ষা মাতা সম্মানার্হ।
জেরুশালেম থেকে কয়েকজন ফরীশী ও ব্যবস্থার শিক্ষক যীশুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন৷ তাঁরা যীশুকে বললেন, ‘আমাদের পিতৃপুরুষরা যে নিয়ম আমাদের দিয়েছেন, আপনার অনুগামীরা কেন তা মেনে চলে না? খাওয়ার আগে তারা ঠিকমতো হাত ধোয় না!’ এর উত্তরে যীশু তাঁদের বললেন, ‘তোমাদের পরম্পরাগত আচার পালনের জন্য তোমরাই বা কেন ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করো? কারণ ঈশ্বর বলেছেন, ‘তোমরা বাবা-মাকে সম্মান করো৷’আর যে কেউ তার বাবা মায়ের নিন্দা করবে, তার মৃত্যুদন্ড হবে (মথি, অধ্যায় ১৫)
আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, যার মা আছে সে কখনোই গরীব নয়।
মাকে নিয়ে যত কথাই বলা হোক বা লেখা হোক না কেন তবুও কমতি থেকেই যাবে। ভালোবাসা সব সময় অনুভবের বিষয় আর মায়ের ভালোবাসা আরো গভীরভাবে অনুভবের বিষয়। মাকে ভালোবাসুন, তাঁর ভালোবাসা অনুভব করুন। তাঁর মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করুন। পৃথিবীর সকল মায়েদের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা..
লেখক: সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সাতক্ষীরা