
বিশ্বের বজ্রপাত প্রবণ দেশের একটি বাংলাদেশ। নাসার তথ্য অনুযায়ী বজ্রপাতের অন্যতম হট স্পট বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০ টি বজ্রপাত হয় । বিশে^ প্রতিদিন ৩০ লাখ বজ্রপাত হয়। অর্থ্যাৎ প্রতি সেকেন্ডে ৪৪ টি। ফিনল্যা-ের বজ্রপাত বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালার ও বলেছেন যে , বজ্রপাতের অন্যতম হটস্পট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সাল থেকে বজ্রপাতের উপর সার্কের আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের (এস এম আরসি) পরিচালিত গবেষণার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও মৃত্যু ঝুকির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বোচ্চ। সার্কের অন্য সদস্যের তুলনায় বাংলাদেশের বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং, সেফটি ইনস্টিটিউটের ‘২০১০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবছর বিশে^ বজ্রপাত যে মৃত্যু ঘটে তার এক চতুর্র্থাংশ হয় বাংলাদেশে।
বিশ^ব্যাপী অতিদ্রুত নগরায়ণ , জীবাশ্ম জ¦ালানী অতিমাত্রায় ব্যবহারে কার্বনডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রীন হাউস গ্যাসের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক গতিতে বৃিদ্ধ পাচ্ছে। তাপমাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে ত্বরান্বিত হওয়ায় বজ্রপাতের সম্ভাবণা অধিক হয়। গবেষকদের ধারণা তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবণা ১০ থেকে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিক তাপমাত্রা বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাছাড়া নির্বিচারে বনভূমি উজাড়, বঙ্গোপসাগর থেকে সক্রিয় মৌসুমি বায়ু প্রবাহ হিমালয়ের পাদদেশে পূঞ্জীভূত মেঘ, কিউমোলোনিস্বাস, দেশব্যাপী বিস্তৃত মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে সৃষ্ট অতিমাত্রায় ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও ওয়েব বজ্রপাতের জন্য দায়ী। বাংলাদেশে জলাশয় ভরাট করাকেও বজ্রপাতের কারণ বলে অনেকেই মনে করেন।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে বজ্রপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বজ্রপাতের কারণে প্রাণহাণির সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে । বাংলাদেশে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বজ্রপাত হয়ে থাকে। মার্চ থেকে মে মাসে সংগঠিত হয় ৫৯ শতাংশ এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বর হয় ৩৬ শতাংশ। মোট বজ্রপাতের প্রায় ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুনে । গবেষণায় দেখা গেছে ২৪ ঘন্টার মধ্যে বেশি বজ্রপাত হয় রাত ৮ টা থেকে ১০ টার মধ্যে , ১২ শতাংশ এবং সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত পর্যন্ত হয় ২৮.৫ শতাংশ।
২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত একটি পরিসংখ্যান হলো-
সাল
মৃত্যুর সংখ্যা
২০১১
১৭৯ জন
২০১২
২০১ জন
২০১৩
১৮৫ জন
২০১৪
১৭০ জন
২০১৫
২২৬ জন
২০১৬
৩৯১ জন
২০১৭
৩০৭ জন
২০১৮
৩৫৯ জন
২০১৯
১৯৮ জন
২০২০
১৪৭ জন
২০২১
১০৭ জন
সূত্র : কালের কণ্ঠ , ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১।
বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে অধিকাংশই কৃষক। ফিনল্যা- বজ্রপাত গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ভাইসালার এক গবেষণায় বলেছেন-বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ৭০ শতাংশ ঘটনা কৃষি কাজের সময় ঘটে। বাড়ী ফেরার পথে ১৪ শতাংশ এবং গোসল ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশের মৃত্যু হয়।
বজ্রপাতে শুধু মৃত্যুই ঘটে না। বজ্রপাতে মানুষ বজ্রাহত হয় এবং বজ্রাহত হওয়ার পর মানুষের শরীরে বিভিন্ন পাশ^প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যেমন স্মৃতিলোপ বা স্মৃতিভ্রম, খিচুনি, পক্ষাঘাত, শ্রবণক্ষমতা লোপ বা কানে কম শোনা, অন্ধত্ব, নিদ্রাহীনতা, মাথাব্যাথা, শরীর অসাড় বা অবশ হয়ে যাওয়া। তবে শ্রবণ ও দর্শন জনিত সমস্যার লক্ষণ অনেক দেরীতে দেখা যায়।
বজ্রপাতের প্রাণহানির সংখ্যা বৃৃদ্ধি পাওয়া এবং বজ্রাহত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করেন। সরকার বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সরকার বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটনাকে রোধ করার জন্য লাইটার অ্যারেস্টার সম্বলিত বজ্রপাত নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি সবচেয়ে বেশি।
বজ্রপাত প্রবণ ২৩ জেলাকে বজ্রপাত দুর্যোগ অ ল হিসাবে ঘোষণা করেছেন। এ সব এলাকায় ‘ লাইটার ব্যারেস্টার ’ সম্বলিত বজ্রপাত নিরোধ কংক্রিটের ছাউনি তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করে দিন। প্রাথমিক ভাবে হাওর অ লে এক কিলোমিটার পরপর এক হাজার ছাউনি নির্মানের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বজ্রপাতের সম্ভাবণা তৈরী হলেই যেন কৃষকরা এ ছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। উল্লেখ্য যে বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রায় ৭৪ শতাংশই কৃষক। সরকার বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে, আরলি ওয়ানিং সিস্টেম বা বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্র বসানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এ যন্ত্র সাইক্লোনের মতো আগাম সর্তকর্তা প্রদান করবে । এ যন্ত্র ৪০ মিনিট পূর্বের কোথায় বজ্রপাত হবে তা আগাম জানিয়ে দেবে। বজ্রপাতে কৃষকদের মৃত্যু হার বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয় হাওরা লের কৃষকদের জীবন সুরক্ষায় বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন নামক একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে। যার ব্যয় হবে ২৩১ কোটি টাকা।
বজ্রপাতের প্রাকৃতিক নিরোধক তালগাছ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন তালগাছের কার্বনস্তর বেশী হওয়ায় সেটা বজ্রপাত নিরোধের সহায়ক হবে। সরকার তালগাছের গুরুত্ব অনুধাবণ করে ২০২১ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ৩১ লাখ ৬৪ হাজার তালবীজ রোপন করেছে। পাশাপাশি জনগণকেও উদ্বুদ্ধ করছে তালগাছ না কাটার জন্য এবং তাল বীজ রোপন করার জন্য।
বজ্রপাত বর্তমান আমাদের দেশে অনাকাঙ্খিত মৃত্যু ঘটাচ্ছে। তাই সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দায়িত্ব রয়েছে। সচেতনতাই এ সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবছর ২৫ মিলিয়ন বজ্রপাত হয়। কিন্তু মৃত্যুর হার অতি নগণ্য গড় ৫০ জন। জাপানে প্রতিবছর বজ্রপাত হয়। প্রায় ১০ লাখের মতো গড় মৃত্যু ৩ জন। সচেতনতার সাথে সাথে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেও এ সংকট থেকে ক্ষতির পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। যেমন- মোবাইল অ্যাপের ব্যবহার মোবাইল অ্যাপ সিদিলু ব্যবহার করে ভারতের সর্বাধিক বজ্রপাত প্রবণ কর্ণাটকে মৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছে। এ অ্যাপ ব্যবহারকারী বজ্রপাতের ৪৫ মিনিট পূর্বের সংকেত পেয়ে থাকে না। আমরা যদি এ ধরণের মোবাইল অ্যাপ চালু করতে পারি তাহলে অপ্রত্যাশিত এ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ,মাগুরা।