অবশেষে চলতি বছরেই দক্ষিণ জনপদের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু, যানজট কমাতে জনগণের জন্য মেট্রোরেল ও যোগাযোগ সেক্টরের নিরব বিল্পব ঘটাতে কর্ণফুলী টানেল খুলে দেওয়া আভাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু পদ্মা সেতু চালু হলেই ১ দশমিক ২ শতাংশ অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি বাড়বে। মেট্রোরেল নিয়ে এখনও প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়নি। এটা চালু হলে পণ্য পরিবহন বাড়বে, সব মিলিয়ে প্রবৃদ্ধিও বাড়বে বলে জানালেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।
তিনি জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পটি আগামী জুন মাসে, কর্ণফুলী টানেল খুলে দেওয়া হবে চলতি বছরের অক্টোবরে আর মেট্রোরেল খুলে দেওয়া হবে বছরের শেষ দিকে (ডিসেম্বর)। মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে প্রেস ব্রিফিং সাংবাদিকদের এসব জানান তিনি। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এ সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ বিষয়ে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম আশাপ্রকাশ করে বলেছেন, ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই প্রথম পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা শুরু হতে দীর্ঘ সময় লাগলেও আগামী ৩০ জুনে খুলে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী একনেক সভায় মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের জানান। স্বপ্নের এই সেতু চালুর পর থেকে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাসহ পুরো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। বলা যেতে পারে বদলে যাবে দেশের অর্থনৈতিক চেহারা।
পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা ৪ হাজার শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই শ্রমিকের মধ্যে প্রায় এক হাজার শ্রমিক চীনের। বাকি তিন হাজার দেশীয় শ্রমিক। করোনার আগে প্রতিদিন প্রায় ৫-৭ হাজার শ্রমিক কাজ করতো। এখন কিছুটা কমে গেছে। তবু আমরা চেষ্টা করছি যথাসময় প্রকল্পের কাজ শেষ করতে। একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছে ৩০ জুনে খুলে দেওয়ার জন্য। আমরা যথাযথ সময়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার জন্য জোর প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের জানান, প্রধানমন্ত্রী সড়কপথে গত ২৬ ডিসেম্বর সেতু এলাকায় আসেন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে। তিনি ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে পদ্মা সেতুর ৭ নম্বর পিলার থেকে ১৮ নম্বর পিলার পর্যন্ত হেঁটে যান। সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটে তারা সেতু এলাকা পরিদর্শন শেষে রাজধানীর উদ্দেশে রওনা হন। আমরা প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পের সকল সেক্টরের লোকজন সুষ্ঠুভাবে কাজ সম্পন্ন করার সবোর্চ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
একনেক সভা শেষে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম জানান, শুধু পদ্মা সেতু চালু হলেই ১ দশমিক ২ শতাংশ অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি বাড়বে। মেট্রোরেল নিয়ে এখনও প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়নি। এটা চালু হলে পণ্য পরিবহন বাড়বে, সব মিলিয়ে প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। এছাড়া একনেক বৈঠকে ১১ হাজার ২১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার ১০টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় ১১ হাজার ২১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, শুধু ঢাকায় নয়, আগামীতে চট্টগ্রামেও প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেল নির্মাণের কথা বলেছেন। আমরা জানি ইতোমধ্যে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। আশা করি, দ্রুত সময়ে সংশ্লিষ্টরা চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প একনেক সভায় পাঠাবেন। আমরাও এটা অনুমোদন করে দেব।
তিনি আরও বলেন, যেখানে বড় বড় শহর আছে, এ ছাড়া যে সব শহরে বিমানবন্দর আছে, সেখানেও মেট্রোরেল হতে পারে। এই বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। এ ছাড়া চলতি বছরেই পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেল জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা কর্ণফুলী সুড়ঙ্গ হল কর্ণফুলী নদীর নিচে অবস্থিত নির্মাণাধীন সড়ক সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গটি কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। এই সুড়ঙ্গ মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। বঙ্গবন্ধু টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেলের নির্মাণকাজ প্রায় তিন চতুর্থাংশ শেষ হওয়ার পর দুই প্রান্তের সম্ভাব্য যানজট নিরসনে নতুন করে পরিকল্পনা করতে বসেছে কর্তৃপক্ষ। টানেল চালুর ১০ বছর পর দুই প্রান্তে যানজটের সমস্যা হবে বলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) সতর্কবার্তা পেয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে সেতু বিভাগ।
অদূর ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ বিবেচনায় টানেলসহ সংশ্লিষ্ট সড়ক অবকাঠামোকে আগামী ১০০ বছরের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য নতুন পরিকল্পনা করা হয়।
সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, ১০ বছর পর্যন্ত টানেল দিয়ে যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করবে তাতে যানজট হওয়ার আশংকা নেই। আনোয়ারা ও কক্সবাজার কেন্দ্রিক শিল্পাঞ্চলে উৎপাদন শুরু হলে তখন যানবাহনের চাপ বাড়বে। সেই চাপ সামাল দেওয়াসহ আগামী ১০০ বছরের জন্য যানবাহন চলাচলে পরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো তৈরির জন্য ‘আলাদা পরিকল্পনা’ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
টানেলের উত্তরপ্রান্তে বা চট্টগ্রাম শহরের অংশের প্রয়োজনীয় সড়ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এবং দক্ষিণ প্রান্তে বা আনোয়ারা অংশের অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরিকল্পনার জন্য সেতু বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। টানেল চালুর বছরে টানেল দিয়ে ৬৩ লাখ গাড়ি এবং কক্সবাজারের গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চালুর পর ২০৩০ সাল থেকে বছরে এককোটি ৩৯ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারে বলে ওই সমীক্ষায় ধারণা দেওয়া হয়েছে। এর ৫০ শতাংশই পণ্যবাহী গাড়ি সিডিএ কর্তৃপক্ষ জানান।