শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিরোনাম: তাপপ্রবাহের কারণে স্কুল-কলেজে ৭ দিনের ছুটি ঘোষণা    আ.লীগের সব রকম কমিটি গঠন ও সম্মেলন বন্ধ থাকবে : কাদের    ঈদযাত্রার ১৫ দিনে সড়কে ঝরল ৪০৭ প্রাণ    প্রাথমিক স্কুলে অ্যাসেম্বলি বন্ধ রাখার নির্দেশ    আজ কী বার্তা দিতে চান সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ!    খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: প্রধানমন্ত্রী    বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে: রাষ্ট্রপতি   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
গৌরবে সৌরভে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেখ মফিজুর রহমান
প্রকাশ: শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৭:৩৫ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রাচীনতম, সর্ববৃহৎ এবং উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এক ঐতিহাসিক আনন্দ ও গৌরবের মাহেন্দ্রক্ষণে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে। বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স যখন ৩৮৫ বছর, ক্যামব্রিজের ৭৫৫ বছর, অক্সফোর্ড ৯১৫ বছর, অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স কেবল ১০০ বছর। মহাকালের গর্ভে ১০০ বছর খুব বেশি না হলেও একটি দেশের জন্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিপুল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী, শিক্ষক অনেকেই রক্ত দিয়ে এর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তাই বিশ্বের যে কোনো প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বসেরা। ১৯২০ সালে ভারতীয় বিধানসভায় গৃহীত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনবলে ১৯২১ সালের ১ জুলাই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। ঢাকার রমনা এলাকার প্রায় ৬০০ একর জমি নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর প্রাথমিক অবকাঠামোর বড় একটি অংশ গড়ে ওঠে ঢাকা কলেজের শিক্ষকমন্ডলী এবং কলেজ ভবনের (বর্তমান কার্জন হল) ওপর ভিত্তি করে। তিনটি অনুষদ (কলা, বিজ্ঞান ও আইন), ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন ছাত্র-ছাত্রী এবং তিনটি আবাসিক হল নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মুখ্য সংগঠক হিসেবে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখের নাম এ জনপদের মানুষ আজীবন স্মরণ রাখবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় লেখা ছিল- এই প্রতিষ্ঠান শুধু জ্ঞান বিতরণের জন্য স্থাপন করা হচ্ছে না, নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানুষ গড়ে তোলাই এর মূল উদ্দেশ্য। এ প্রতিষ্ঠানের শুরুতেই যুক্ত হয়েছিলেন ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার, মহোমহপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো কীর্তিমান মহাপুরুষগণ। এ জনপদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস রচনা ও পঠন-পাঠনে তাঁদের কৃতিত্বপূর্ণ অবদান ছিল। পরবর্তীকালে শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন স্যার এ এফ রহমান, অধ্যাপক মাহমুদ হাসান, অধ্যাপক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসাইন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসু, মোহিতলাল মজুমদার, জসীমউদ্দীন, হরিদাশ ভট্টাচার্য, কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল মতিন চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, তালুকদার মনিরুজ্জামান, সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক ও বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আহমদ শরীফ প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিক্সের উদ্ভাবক, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফির ওপর গবেষণাকর্মের সূচনা করেন, যা পরবর্তীতে তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। ১৯২৪ সালে তাঁর ‘প্ল্যাঙ্কস ল অ্যান্ড দ্য লাইট কোয়ান্টাম হাইপথেসিস’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। প্রবন্ধটি বিজ্ঞান জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং ‘বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব’ নামে সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়। তাঁর নামানুসারে পরমাণুর এক ধরনের কণিকার নাম রাখা হয়েছে ‘বোসন কণা’। এমনসব বিরল কৃতিত্বপূর্ণ শিক্ষকের পদচারণায় মুখর ছিল এ বিদ্যাপীঠ।

মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবদান ছিল গৌরবজনক। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভার আয়োজন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তিনি ঢাকার দুটি সভায় বক্তৃতা দেন এবং দুই জায়গায়ই তিনি বাংলা ভাষার দাবিকে উপেক্ষা করে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। জিন্নাহর বক্তব্য তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়ে। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের ওপর গুলি চালালে অন্যদের সঙ্গে শহীদ হন আবুল বরকত (রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ শ্রেণির ছাত্র)। বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে নিয়ামক প্রেরণা জুগিয়েছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে দেখিয়েছে নতুন পথ, নতুন আলো। সে আলোর পথ ধরে এগিয়ে গেছে এ জনপদের মানুষ। প্রবেশ করেছে এক নতুন যুগে। সে যুগ স্বাধীন বাংলাদেশের যুগ। জন্ম নিয়েছে একটি স্বাধীন ভাষিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭১- প্রত্যেকটি আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে কারণে গোলাপ যেমন একটি বিশেষ প্রজাতির ফুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তেমনি হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়।
২৫ মার্চের গণহত্যার (অপারেশন সার্চলাইট) প্রথম পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়। ১৯৭১-এ ড. গোবিন্দচন্দ্র (জিসি) দেব (দর্শন বিভাগ), ড. এ এন এম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান বিভাগ), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস বিভাগ), ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি বিভাগ), মুনীর চৌধুরী (বাংলা বিভাগ), মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা বিভাগ), ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস বিভাগ), ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট), রাশীদুল হাসান (ইংরেজি বিভাগ), আনোয়ার পাশা (বাংলা বিভাগ), ড. ফজলুর রহমান (মৃত্তিকা বিভাগ), গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস বিভাগ), ড. ফয়জুল মহি (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট), আবদুল মুকতাদির (ভূতত্ত্ব বিভাগ), শরাফৎ আলী (গণিত বিভাগ), সাদত আলী (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট), আতাউর রহমান খান খাদিম (গণিত বিভাগ) এবং অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (পদার্থবিদ্যা বিভাগ); ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ মর্তুজা এবং ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেকসহ একাধিক ছাত্র শহীদ হন। শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহু কীর্তিমান শিক্ষার্থী জাতিকে উপহার দিয়েছে। শতবর্ষের সেরা শিক্ষার্থী হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী যিনি বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতি। এ উদাহরণ বিশে^ বিরল। আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র। একই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন বহু ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্ররা বিশেষ গৌরব বোধ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরও কৃতী ছাত্র উপহার দিয়েছে- যাঁরা দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে যাঁরা দেশ এবং আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছেন, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম (বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দীন আহমদ (বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী), মোজাফফর আহমেদ (মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ), নুরুল ইসলাম, খান সারওয়ার মুরশিদ, কবীর চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবদুল মতিন চৌধুরী, মোকাররম হোসেন, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, স্থপতি ফজলুর রহমান খান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মুহম্মদ আবদুল হাই, অজয় রায়, রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, আবুল মাল আবদুল মুহিত, এম এ ওয়াজেদ মিয়া, এস এ এম এস কিবরিয়া, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ, এ কে নাজমুল করিম, রওনক জাহান, নাজমা চৌধুরী, রেহমান সোবহান, ড. কামাল হোসেন, জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী, শওকত আলী, শামসুর রাহমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জাহানারা ইমাম, হুমায়ুন আজাদ, সেলিম আল দীন, হুমায়ূন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, আহমদ ছফা, সলিমুল্লাহ খান অন্যতম। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বহু দিক বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (বাংলাদেশ সংবিধানের প্রধান নকশাবিদ) এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর সময়ে এ ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করতেন পটুয়া কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমদ, কাজী আবদুল বাসেত, আমিনুল ইসলাম প্রমুখ। এ অনুষদ থেকে বহু বরেণ্য শিল্পী দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার মধ্যে শিল্পী হামিদুর রহমান (শহীদ মিনারের অন্যতম স্থপতি), মোহাম্মদ কিবরিয়া, হাশেম খান, রফিকুন নবী, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, কাজী গিয়াসউদ্দিন, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালেদ (অপরাজয় বাংলার ভাস্কর), সমরজিৎ রায় চৌধুরী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান লোগোর ডিজাইনার), হামিদুজ্জামান খান প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাক্তন ছাত্র শিল্পী মনিরুল ইসলাম, (এই মুহুর্তে বিশে^র অন্যতম সেরা শিল্পী)। তাঁর শিল্পরীতি ‘স্কুল অব মনিরো’ ইউরোপের প্রতিটি চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। শিল্পী শাহাবুদ্দিন ফ্রান্সের অন্যতম সেরা চিত্রশিল্পী। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কলা, বিজ্ঞান, চারুকলা, সমাজবিজ্ঞান প্রতিটি শাখায় বিশে^ সুনাম অর্জন করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ব্রজেন দাস সাঁতারে প্রথম ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ড. মুহম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন। র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সাবেক শিক্ষার্থী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বহু খ্যাতিমান মানুষের পদধূলিতে এ বিদ্যাপীঠ গৌরবান্বিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচালনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন।

মাঝে মাঝে আমার ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দেয়ালে একটি লেখা দেখে মন আনচান করে উঠেছিল- ‘জেগে উঠল কি সময়ের ঘড়ি,/এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি।’ কিশোর কবি সুকান্তের এই চরণ কিশোর তথা প্রাক-যৌবনে আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। বিপ্লবী হওয়ার চেষ্টাকে বাড়িয়ে দেয়। তাই সে সময়ের উত্তপ্ত জাতীয় রাজনৈতিক তাপ আমাকেও দগ্ধ করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে বলতে চাই, আমাদের মধ্যে অহংবোধ নয়, একজন ভালো মানুষ জন্মগ্রহণ করুক, মমতা ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটুক পূর্ণ মাত্রায়। ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আমাদের হৃদয় আরও প্রস্ফুটিত হোক যাতে আমরা আরও বেশি সেবা ও ভালোবাসা দিতে পারি। জীবনের উদ্দেশ্য তো তাই। দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করতে পারলাম কি না- এটাই আসলে সবার কাজের মূল প্রেরণা হওয়া উচিত। এ চিন্তাটা সবসময় সামনে থাকলে একজন মানুষ অসাধারণ অর্জনের শক্তি পায়। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি নিজের কাজ সবচেয়ে ভালো কিংবা সুচারুভাবে করাই প্রকৃত দেশপ্রেম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্ররা যেমন সফলতার গর্বে গর্বিত হন, তেমনি অনেককেই দেখা যায় ব্যর্থতার গল্প শোনাতে। আমি বিশ্বাস করি, সফলতার গল্পে কেবল একটি বার্তা থাকে, কিন্তু ব্যর্থতার গল্পে সফল হওয়ার অনেক উপায় নিহিত থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে শ্রেষ্ঠত্ব একটা অবিরাম প্রক্রিয়া। এটা কোনো নিছক ঘটনা বা দুর্ঘটনা নয়।

জন্ম থেকে আমাদের অনেক ঋণ রয়েছে, যা শোধ করার চেষ্টা করা উচিত। মাথার ওপর যে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে, আমরা কি জানি Tomas Alva Adison ১০ হাজার বার ব্যর্থ চেষ্টার পর তা আবিষ্কার করেন। কীভাবে আপনি এই ঋণ শোধ করবেন? একটাই উপায়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভালো কিছু করে যাওয়া, রেখে যাওয়া। চারদিকে আলো ছড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা করা। সে লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি চাই সংঘবদ্ধ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা। কারণ ব্যক্তি প্রধানত শক্তিহীন- যদি না সে যুক্ত হতে পারে সমষ্টির সঙ্গে। ফেসবুকের জগতে ‘সামাজিক যোগাযোগ’ নয়, প্রয়োজন প্রত্যক্ষ মানবিক যোগাযোগ।

বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমার আপনার ব্যাপক দায়িত্ব রয়েছে, যা আমরা কোনোমতেই অস্বীকার করতে পারি না। জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন কি না, আপনি কঠিন সময়ে ভেঙে পড়েন নাকি স্থিতি থাকতে পারেন- এটাই মানুষ হিসেবে আপনার নিয়ামক যোগ্যতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ভাষায়- ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে, অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহিরে...।’ চোখের আলো হারালেও আমরা যেন মনের আলো না হারাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে এটাই আমার অন্তরের আকুতি।



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে গর্ব ও আনন্দ দুটোই আমার রয়েছে। আসলে জীবন এক যাযাবর। জীবনের প্রয়োজনেই অনেকের সঙ্গে মিশতে হয়, পথ চলতে হয়। আজ প্রচলিত পড়াশোনা শেষ করে তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে, সংসার করছি। জীবনের একেক সময়ের অনুভূতি একেক রকম। প্রত্যেক সময়ের নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। বেঁচে থাকাটাই আনন্দের। ভোরের শিশিরস্নাত সকাল, তরুলতা, গাছপালা ভরা নিঃস্বার্থ প্রকৃতিকে ভালোবেসেও জীবনটাকে উপভোগ করা যায়। যতই টানাপড়েন থাকুক তবুও দিন শেষে জীবন মানে উৎসব। প্রতি মুহুর্তে ইংরেজ কবি Lord Tennyson-এর ভাষায় বলা যায়, ‘I will drink life to the lees’।

সদ্য কৈশোর পেরুনো ছেলে-মেয়েরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন তারা নিতান্তই সাধারণ কিন্তু তুমুল স্বপ্নবাজ। এখান থেকে উত্তীর্ণ হয়েই তারা স্ব-স্ব পেশায় সফলতার শীর্ষে পৌঁছে। এই রূপান্তর দেখাটা সত্যি স্বর্গীয় আনন্দের। বারবার এই আনন্দের দেখা পেতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা যদি আবার বা বারবার আমাকে জন্মলাভের সুযোগ দেন, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মাটিতেই কাজ করতে চাই- অন্য কোথাও নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শত ভাবনা বিকশিত হোক। শত ফুল নিত্য হাসি ফোটাক। শত চিন্তার প্রসারে ঘটুক ব্যক্তি ও জাতির ক্রম-উত্তরণ। স্বপ্নে-কর্মে-উদ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমাগত আরও প্রস্ফুটিত হোক, জনপ্রত্যাশা পূরণ করুক, এটাই আন্তরিক প্রত্যাশা।

লেখক: সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, সাতক্ষীরা

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]