গল্পের শুরুটা নিজের জীবনকে ঘিরেই। প্রতিবন্ধীদের যে কী কষ্ট, আমার প্রতিবন্ধী বোনকে দেখে বুঝতে পারি। জন্মের ৩৮ ঘণ্টার মাথায় মারা যায় আমার নবজাতক ছেলে। পিতার সামনে সন্তানের এই মৃত্যু আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। সন্তানকে বাঁচাতে দৌড়ে বেড়াই চারটি হাসপাতালে। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই বিফলে যায়। সন্তান হারানোর কষ্টের অনুশোচনা সেদিন আমাকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মনোবল তৈরি করে, এরপর একদিন খুকনী গ্রামে চা খাওয়ার জন্য বাইক থামাই। পাশ দিয়ে ফেরদৌস নামের এক শিশু মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে আর অন্য শিশুরা পা দিয়ে তাকে লাথি মারছে, ওই দৃশ্য আমার ভেতরটাকে নাড়া দেয়। এরপর ওই দোকানে গিয়ে সেই প্রতিবন্ধী শিশুটির তথ্য সংগ্রহ করি। সেদিন রাতেই নিজের ফেসবুকে ওই শিশুকে নিয়ে পোস্ট দেই এবং সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। ফেরদৌসের জন্য উপজেলা প্রশাসন এগিয়ে আসে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি একের পর এক অসহায় মানুষ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করে যেতে থাকি। আলাপচারিতায় এমনটিই জানাচ্ছিলেন মানবতার ফেরিওয়ালা মামুন বিশ্বাস।
জন্ম আর বেড়ে উঠা প্রত্যন্ত গ্রামে, সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বেলতৈল ইউনিয়নের আগনুকালী গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন সিরাজগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে, বাবা স্কুল শিক্ষক আর বড় ভাই ব্যবসা করেন, ভাইয়ের সাথে ব্যবসা দেখাশোনার পাশাপাশি অসহায় মানুষ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন এই যুবক। ২০১৩ সাল থেকে বন্যপ্রাণীর জন্য কাজ শুরু করেন, গাছে গাছে মাটির কলস বেধে পাখির নিরাপদ আশ্রয়ে জন্য ব্যবস্থা করেন তিনি। ২০১৪ সাল থেকে মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন অসংখ্য মানুষের। অসহায় মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদান, রাস্তায় পড়ে মানুষকে উদ্ধার চিকিৎসা ও সেবা প্রদান, মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সহায়তা প্রদান, গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ, বন্যার্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিরতণ, প্রতিবছর ঈদ বাজার বিতরণ, হুইল চেয়ার প্রদান, দোকান তৈরিতে সহায়তা, হারানো ব্যক্তিকে খুঁজে দেওয়া, সেলাই মেশিন প্রদান, অটোভ্যান প্রদান, রোহিঙ্গাদের মাঝে অর্থ সহায়তা প্রদান, শীতের পোশাক বিতরণ, গৃহপালিত পশু সহায়তা প্রদান, অসহায় মেয়ের বিয়ের জন্য সহায়তা প্রদান, খুলনার আম্ফানে খাদ্যসামগ্রী ও নলকূপ স্থাপন, সাতক্ষীরায় ইয়াসের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, দুইটি প্যাডেল হুইলচেয়ার বিতারণও বিভিন্ন বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে অবমুক্ত করা। করোনা দুর্যোগে অসহায় ও কর্মহীন মানুষের মাঝে ৫ হাজার পরিবারে প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী বিতরণ ও করোনা দুর্যোগে দুই ঈদে ১ হাজার পরিবারের মাঝে ঈদ বাজার বিতরণ, করোনা দুর্যোগে বানভাসি যমুনার চরে ১৭০০ পরিবারে মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ ও যমুনার চরে। ঈদে গরু কোরবানি দিয়ে অসহায় মানুষের মাঝে মাংস বিতরণসহ বিভিন্ন সময় নানানভাবে মানুষের পাশে দেখা যায় মামুন বিশ্বাসকে।
মামুন বিশ্বাস দৈনিক ভোরের পাতা পত্রিকায় সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজের পাশাপাশি অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষ বিশ্বাস বলেন, আমি যখন এই কাজ শুরু করি তখন আমাকে সবাই পাগল বলতো। তবে আমার বাবা আলহাজ্ব ডাঃ মোঃ মাহবুবুল হোসেন জোস্না ও ভাইয়া মুক্তা বিশ্বাস আমাকে সবসময় সাপোর্ট ও অনুপ্রেরণা দিতেন আমার কাছে। বাবা বলতেন তুমি তোমার কাজ করো মানুষ তোমাকে কি বললো সেটা বড় কথা নয়। তুমি তোমার কাজকে শ্রদ্ধা করো এটাই বড় কথা। আমার কাজ গুলো যখন সফলতা আসতে শুধু করলো বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায় প্রকাশ হলো তখন আস্তে আস্তে আমার এলাকার মানুষ আমার কাজে সহযোগিতা করতে শুরু করলো। তখন সবাই আমাকে অনুপ্রেরণা ও পাশে থেকে কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। যমুনার চর অঞ্চলে যখন আমরা খাদ্যসামগ্রী বা শীতবস্ত্র বিতরণ করতে যাই তখন নৌকায়, ঘোড়ার গাড়িতে, পায়ে হেটে মালামাল বহন করতে হয়। রাস্তায় পড়ে কোন অসুস্থ মানুষকে যখন উদ্ধার করি বা হাসপাতালে ভর্তি করি তখন আমাদের নিজেদের তাদের দেখাশোনা করতে হয়। কারো ঘর বানাতে গেলে সব কিছু কেনাকাটা করে আমাদের দিয়ে আসতে হয়। বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হই। যেমন অজগর সাপ উদ্ধার করতে গেলে গ্রামের মানুষ বন্যপ্রাণীর আইন বুঝে না তখনে আমাদের কাছে টাকা দাবী করে থাকে। তাদেরকে বুঝাতে হয় আইন সম্পর্কে। এই কাজগুলো করতে নিজের অনেক কষ্ট হলেও মানুষ আর প্রাণীদের নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করে বাধা পেরিয়ে যান তিনি, তার এই কাজের জন্য সবাই এখন ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ বলে ডাকে ।
মামুন বিশ্বাস আরও বলেন, ২০১৬ সালে জনপ্রিয় ইত্যাদি অনুষ্ঠানে হানিফ সংকেত স্যার ‘ফেসবুকের ভিন্ন ব্যবহার’ এর উপর একটি প্রতিবেদন প্রচার করেন। সেই প্রতিবেদনে দেশ ও দেশি বাহিরে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তখন থেকে আমার আর ফিরে তাকাতে হয় নাই। তার পর দেশ ও দেশের বাহিরে টেলিভিশন ও পত্রিকায় আমাদের কাজ গুলো প্রচার হয়। আমার যে কোন পোস্ট ফেসবুকে দিলে দেশ ও দেশের বাহিরে প্রবাসী ভাই ও বোনেরা টাকা পাঠায়। আমাদের প্রতিটি পোস্ট কাজের ও টাকার হিসাব দেওয়া হয়। আমার এই কাজের কৃতিত্ব ফেসবুক বন্ধুদের, আমি মাত্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ইত্যাদি অনুষ্ঠান আমাকে মানুষের জন্য কাজ করতে বড় সাফল্য এনে দিয়েছে।
জানা যায়, ২০১৬ সালে ইত্যাদি প্রতিবেদন প্রচার হওয়ার পরেরদিন তৎকালীন সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দিকী ও শাহজাদপুরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আহম্মেদ আনুষ্ঠানিক ভাবে সন্মাননা ও ক্রেস্ট প্রদান করেন। ২০১৭ সালে এটু আই, বিটিভি ও জাইকার যৌথ উদ্যোগে ২৪ মিনিটে ‘গল্প নয় সত্যি’ ডুকুমেন্টারী বানান, যা বাংলাদেশের প্রতিটি ডিজিটাল ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র সিডি সরবরাহ করে। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন থেকে সন্মাননা পান এই যুবক। করোনা দুর্যোগে ব্যাপক পরিসরে কাজ করায় এটুআই,আইটি ডিভিশন, কেবিনেট ডিভিশন, ইউএনডিপি ওসি এন আই মিলে ‘করোনা বীরযোদ্ধা’ হিসেবে খেতাবও পেয়েছেন তিনি।
মানুষের সমস্যার কথা জানলেই ফেসবুকে পোস্ট করেন মামুন, এরপর দেশে বিদেশ থাকে আসে আর্থিক সহায়তা। মানুষের সমস্যার কথা জানানোর তথ্যদাতারা কারা?। মামুনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ফেসবুক প্রোফাইলে ৯৫ হাজার ফলোয়ার পেইজে ৩৬ হাজার ফলোয়ার আছে। এছাড়াও ২০জন স্বেচ্ছাসেবক আছে, ‘আমাদের সিরাজগঞ্জ’ নামে ফেসবুক গ্রুপে সাড়ে চার লক্ষ সদস্য আছে তারাই মূলত আমাকে ফেসবুক ইনবক্সে, ইমেইলে আর ফোন করে মানুষের সমস্যার কথা জানান।
মামুন বিশ্বাস সারাজীবন মানুষ ও বন্যপ্রাণীর জন্য কাজ করে যেতে চান, স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশর প্রতিটি ইউনিয়নে তরুন প্রজন্ম একযোগে কাজ করবে। কারো কোনো সমস্যা হলে প্রতিটি ইউনিয়ন থেকেই উদ্যোগ দিবে মানুষ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। মামুন বিশ্বাস বলেন, দিনশেষে একজন অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারি, একটা আটক বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে মুক্ত আকাশে উড়াতে পারি এটা তৃপ্তি, এটাই বেচে থাকার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা বেশিভাগ মানুষ এখন ফেসবুক ব্যবহার করি তার মধ্যে তরুণ প্রজন্ম বেশি। সবাই যদি ফেসবুকে প্রতিদিন একটা ভাল কাজের পোস্ট দেয় তাইলে দেখবেন অন্যরাও অনুপ্রেরণা পাবে। আর প্রতিটি পরিবারে উচিত সন্তানকে সামাজিক কাজে অনুপ্রাণিত করা। ফেসবুক অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। আমি বিশ্বাস করি এখন বাংলাদেশের অনেক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবক অনলাইনে সামাজিক কাজ করে। সবাই যদি ফেসবুক টাকার হিসাব পোস্ট দেয় তাইলে যারা সাহায্য পাঠাতে চান তারা আরো অনুপ্রেরণা পাবে। এখন অনেকেই মোবাইল গেইমে আসক্ত হচ্ছে, এই সময়টা যদি ভাল কাজে লাগাই তাইলে দেশের অনেক অসহায় মানুষ ভাল থাকার স্বপ্ন দেখবে।