রোজা শেষে আর কয়েকদিন পর ঈদ। তবে এখনও জমে উঠেনি দেশের ঈদ বাজার। এতে ব্যবসায়ীদের কপালে দেখা দিয়েছে চিন্তার ভাঁজ। ঈদ ঘনিয়ে আসলেও মানুষের হাতে নেই নগদ টাকা। ফলে ঈদের কেনা কাটা শুরু করেনি দেশের অধিকাংশ মানুষ। গত বছরের মতো এবারও ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন তারা তাদের দোকান খরচ তুলতে পারবেন না।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির এক তথ্যে দেখা যায় করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর লক্ষে চলমান লকডাউনের কারণে সারা দেশের ৬০ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। কারণ হিসাবে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির নেতারা বলছেন রমজানের অধিকাংশ সময় বন্ধ ছিল দেশের বিপণি বিতান। ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার রমজানের মাঝামাঝি সময়ে দোকান খোলার অনুমনি দেয়। তবে গণ পরিবহন বন্ধ থাকায় এসব বিপণি বিতানে যেতে পারেনি সাধারণ মানুষ। এতে দোকান খোলা রাখলেও ক্রেতা শূন্য ছিল বিপণি বিতানগুলো।
করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে সকাল ১০ থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকানপাট, মার্কেট-শপিংমল খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছে সরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঈদকে সামনে রেখে আশানুরূপ ক্রেতা পাচ্ছে না রাজধানীর মার্কেট-শপিংমলগুলো। ব্যবসায়ী নেতাদের মতে করোনায় ভেঙে পড়েছে বাজার ব্যবস্থা। করোনার কারণে বড়, মাঝারি, ছোট সব ধরনের শিল্পখাত বিপর্যস্ত। কৃষিখাতে উৎপাদন বন্ধ না হলেও ফসল সংগ্রহ ও বাজারজাত নিয়ে বেকায়দায় কৃষক। কুলি, মজুর, অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বিপুল পরিমাণ মানুষের আয়ের পথ বন্ধ।
গতকাল বুধবার বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় দোকান-মার্কেটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতাদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। মার্কেটের প্রতিটি দোকানে নতুন কালেকশনসহ পর্যাপ্ত মালামাল থাকলেও দেখা মিলছে না ক্রেতার। ফলে বেচা-বিক্রি ছাড়াই বসে থাকতে হচ্ছে দোকানমালিকদের।
মধ্য বাড্ডার হাজী নূরনবী মার্কেটের জেন্টেল ফ্যাশনের মালিক এরশাদ আলী বলেন, সকাল থেকে দোকান খুলে বসে আছি। কিন্তু ক্রেতার সংখ্যা কম। অন্যান্য বছর ঈদের বাজারে মার্কেটে পা ফেলার জায়গা থাকত না। পুরো মার্কেটে ক্রেতার ভিড় লেগে থাকত। সকাল থেকে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত এমন চিত্র দেখা যেত। কিন্তু এবার সব দোকানিই ফাঁকা বসে আছেন। দু-একজন কাস্টমার এলেও বিক্রি হচ্ছে না।
একই এলাকার হাসেম আলী খান সুপার মার্কেটের কাপড় ব্যবসায়ী আব্দুস সোবহান বলেন, আমার দোকানে মোটামুটি ভরপুর মালামাল আছে। আছে নতুন নতুন কালেকশন। তবুও সাধারণ ক্রেতাদের তেমন একটা আনাগোনা নেই। অন্য যে কোন ঈদের এ সময় নিজের দোকানের ৩-৪ জন কর্মচারী ছাড়াও চুক্তিভিত্তিক আরও কর্মচারী নিয়োগ দিতে হত। এবার আর তা নেই।
কর্মচারীরা অলস সময় পার করছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ক্রেতা মূলত নিম্ন আয়ের মানুষ। আসলে এসব মানুষের কাছে এখন টাকা নেই। সে কারণে তারা ঈদের কেনাকাটা করতে আসছে না। যে অল্প কয়েকজন আসছেন, তারা বাধ্য হয়ে কিনছেন। ঈদের আগে কাপড়ের দোকানিদের বসে থাকার সুযোগ নেই। অথচ দেখুন, বেশিরভাগ দোকানিই ক্রেতা ছাড়া ফাঁকা বসে আছেন। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এই মার্কেটে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছেন হুমায়ুন কবীর।
তিনি বলেন, আমি একজন ছোট ব্যবসায়ী, করোনাকালের জন্য আমার ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। আগের যে কোন ঈদের কেনাকাটা করার জন্য আলাদা বাজেট থাকত আমাদের। এর আগে প্রতি ঈদে আত্মীয়-স্বজনদের জন্যও জামা-কাপড় কিনতাম। কিন্তু এবার হাতের অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে অন্য সবার জন্য কেনার ইচ্ছে থাকলেও কেনা হচ্ছে না। এবার শুধু আমার দুই সন্তানের জন্য ঈদের জামা কিনতে এসেছি।
বেশিরভাগ মানুষের হাতে টাকা নেই। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য এলাকাভিত্তিক মার্কেট-দোকানগুলো ফাঁকা। অন্যবারের মতো ক্রেতাদের ভিড় নেই। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে দেশের প্রতিটি খাত চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে শ্রমিক ছাঁটাইসহ নানামুখী কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমেছে সাধারণ মানুষের আয়। মহামারির এ সময়ে দেশে নতুন করে আরও দেড় কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে ফ্যাশন হাউজের বিক্রি বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন দেশের তাঁতশিল্প ও অ্যামব্রয়ডারি খাতের উদ্যোক্তা-কারিগররা। আর মোট অর্থনীতিতে শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতে লকডাউনে দিনে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। কাঁচামালের অভাবে দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানার উৎপাদন সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রাণঘাতী করোনা প্রাদুর্ভাবের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যে। এরই মধ্যে দেশের অন্তত ১৪টি খাতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের কারণে রমজান কেন্দ্রিক ব্যবসায়িক আয়োজন নিষ্প্রভ। নেই চিরচেনা সেই উৎসবের পরিবেশ। অবরুদ্ধ পরিবেশ, আয়-উপার্জনের সীমাবদ্ধতা, বৈশ্বিক বাণিজ্য চেইন ভেঙে পড়া ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে ব্যবসায়ীরা হতাশ। এদিকে রমজানে বিক্রির লক্ষ্যে পণ্য মজুদ করলেও লোকসানের শঙ্কায় আছেন দোকান মালিকরা। তারপরও রোজা বা ঈদের বাজার ধরতে সব দিক থেকে প্রস্তুত তারা।
বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনায় ব্যবসায়ীক ক্ষতির পরিমাণ নির্দিষ্ট করে বলার সময় এখনও আসেনি। কারণ দোকান খোলা তবে বন্ধ রয়েছে সবকিছু। আমাদের পুঁজিই নেই। তাহলে আমরা কিভাবে এই ক্ষতির হিসাব করবো। প্রায় এক মাস ধরে সবধরনের দোকান পাট বন্ধ। তারপরও আমরা একটা গ্রস হিসাব করেছি। তবে এটা চূড়ান্ত নয়। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের লাভের ক্ষতি যদি ধরা হয় তারা গড়ে ২০ হাজার টাকা করে সেল করলে আমাদের ৬০ লাখ ব্যবসায়ীর প্রতিদিন ১৫০০ কোটি টাকার ব্যবসায়ীক ক্ষতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা এখন অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে আছি। কোথায় গিয়ে শেষ হবে আমরা জানি না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ীদের বেঁচে থাকটাই বড় বিষয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, প্রাণঘাতী করোনার প্রভাবে দেশের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প খাতে মোট এক হাজার ২৪ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে প্রতিদিন। এর মধ্যে বড় ও মাঝাড়ি শিল্পে প্রতিদিন ক্ষতি ৮১৪ কোটি টাকা। ছোট শিল্প খাতে ক্ষতি ২১০ কোটি টাকা।
এছাড়া বাণিজ্য খাতে (খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়) ৬৬৩ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে প্রতিদিন। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড় খাত- কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দিনে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে। লকডাউন অবস্থা পুরো মে মাস এমনকি জুন মাসেও অব্যাহত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, যদি তাই হয়, তাহলে মে মাস শেষে অনুমিতো ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে লক্ষ্য কোটি টাকা।
ইসলামপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শামসুল আলম সজল বলেন, সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা এখান থেকে কাপড় কেনে। রমজানে এই ব্যবসা বেশি হয়। বকেয়াও পাওয়া যায় এ সময়। কিন্তু প্রায় এক মাস মার্কেট বন্ধ থাকায় আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। সরকার যতই প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলুক না কেন, এই ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো না।
বাংলাদেশ ফ্যাশন অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, কারিগররা প্রায় শতভাগ পণ্য প্রস্তুত করে ঈদের আগেই। সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগেই মজুদ করা হয়েছিল ক্রয়াদেশের অন্তত ৫০ শতাংশের বেশি পোশাক। বেচাকেনা বন্ধ থাকায় শুধু পোশাক খাতে ক্ষতি হতে পারে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। বিপর্যয় দেখা দিয়েছে উৎপাদন ও সাপ্লাই চেইনে। দেশে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ৫ হাজার ফ্যাশন হাউজ। বেচাকেনা বন্ধ থাকায় ক্ষতির শঙ্কায় আছেন এ খাতে জড়িত অন্তত ৫ লাখ মানুষ।
এ বিষয়ে ইয়োলো ফ্যাশনের জেনারেল ম্যানেজার (হেড অব রিটেল অপারেশন) হাদি এস এ চৌধুরী বলেন, ঈদের মধ্যে আমাদের ৪০ দিনের ব্যবসা হয়। এ বছর আমাদের ৮০ ভাগ লোকসান হবে। ক্ষতির পরিমাণ নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। স্নোটেক্সের সহকারী ব্যবস্থাপক (পিআর) শেখ রাহাত অয়ন বলেন, ঈদ মার্কেটের জন্য আমরা শতভাগ বিনিয়োগ করে ফেলেছি। এখন পর্যন্ত রোজা ও ঈদের বাজার ধরতে পারিনি। আমাদের আয় বন্ধ হয়ে গেলেও ব্যয় বন্ধ হয়নি।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, রমজানে আমাদের দেশে ফ্যাশন শিল্প খুব জোরদার থাকে। এবার তাদের ব্যবসা একেবারেই কম হবে। ইতোমধ্যেই তাদের একটা বড় ক্ষতি হয়েছে। এজন্য ই-কমার্সকে জোরদার করা হচ্ছে। যাতে তারা ঈদের বাজারটা ধরতে পারে।