হেফাজতের সঙ্গে আপোসের কারণেই তারা আজ আসকারা পেয়েছে: শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক #হেফাজতের ভয়াল রূপ মানুষের সামনে খোলাসা হয়ে গেছে: অ্যাড. কামরুল ইসলাম #আইন ও সংবিধানের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমেই এদের প্রতিহত করা সম্ভব: মে. জে. (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার
২০১৩ সালের ৫ মে বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য চিরদিন কলঙ্কতম অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। কারণ, এইদিন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামকে একটি গণতান্ত্রিকভাবে, সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে রাষ্ট্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে মানুষের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে, সেই সাংবিধানিকভাবে বৈধ সরকারকে উৎখাত করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। ৫ মে হেফাজতের সেই তা-বে পবিত্র কোরআন শরীফও রক্ষা পাইনি। তাদের সেদিনকার দেওয়া আগুনে কোরআন শরীফও পুড়েছে। শুধু কোরআন শরীফ নয়, অন্যান্য ধর্মের বহু পবিত্রগ্রন্থ সেদিন তারা পুড়িয়েছিল। দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৩৩০তম পর্বে বুধবার আলোচক হিসেবে উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন- সংসদ সদস্য এবং সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাড. কামরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের (আপিল বিভাগ) সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, পিএসসি, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও লেখক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার। দৈনিক ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভোরের পাতার সিনিয়র রিপোর্টার উৎপল দাস।
সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ৫ মে হেফাজতের সেই তান্ডবে পবিত্র কোরআন শরীফও রক্ষা পায়নি। তাদের সেদিনকার দেওয়া আগুনে কোরআন শরীফও পুড়েছে। শুধু কোরআন শরীফ নয়, অন্যান্য ধর্মের বহু পবিত্রগ্রন্থ সেদিন তারা পুড়িয়েছিল। বহু দরিদ্র মানুষকে তারা পুড়িয়েছিল যারা রাস্তায় ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। তাদের লেলিহান আগ্রাসন থেকে সেদিন কেউই রক্ষা পায়নি। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের হুংকার এবং আমাদের যে পুলিশ, বিজিবি, র্যাবের সফল অভিযানে তারা সেদিন শেয়ালের মতো পালাতে বাধ্য হয়েছিল এবং এই কৃতিত্ব আমি দিব সৈয়দ আশরাফ, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব; যারা সেদিন সফলভাবে তাদের তাড়াতে সক্ষম হয়েছিল। আমরা সেদিন লক্ষ্য করেছিলাম সে তান্ডবে যারা অংশগ্রহণ করেছিল তাদের বেশির ভাগ ছিল মাদরাসার ১০-১২ বছরের কোমলমতি ছাত্র। এদেরকে দিয়ে ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানী মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ বায়তুল মোকাররম ও পল্টন এলাকায় বেপরোয়া তান্ডব চালায় হেফাজতে ইসলাম। ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের নামে অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচি দিয়েছিল তারা। সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজধানীতে হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫৩টি মামলা দায়ের করে। আসামি করা হয় হেফাজতের শীর্ষ স্থানীয় নেতাসহ কয়েক হাজার কর্মীকে। মামলার এজাহারে নাম ছিল বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতারও। ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। মতিঝিল এলাকায় প্রায় ৮ ঘণ্টা তান্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো এর পরেই সরকার তাদের সাথে একটি আপোস-মীমাংসায় পৌঁছেছিল। সারা পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে আমরা কোথায় দেখতে পাবো না যে, পরাজিত শক্তির সাথে বিজয়ী শক্তির আপোস হয়েছে। এর ইতিহাস কিন্তু সারা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। সেদিন যদি সেই পরাজিত শক্তিদের সাথে কোন রকম আপোস করা না হতো তাহলে তারা সেদিন সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হতে বাধ্য হতো, আজ এতো বছর পর আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতো না সেই হেফাজতে ইসলাম। সেদি তাদের সাথে আপোস করায় ভ্রান্ত ধারণার কারণে সেদিন তারা বেঁচে গিয়েছিল। আজকে তাদের দ্বারা যেসব ঘটনা ঘটছে সেটা আর হতো না।
অ্যাড. কামরুল ইসলাম বলেন, আসলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে দীর্ঘদিন পর মানে ৭৫’র পর। প্রায় ৩০ বছর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিরা ক্ষমতায় ছিলেন। জিয়া বলেন, এরশাদ বলেন, খালেদা জিয়া বলেন; এরা প্রায় ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। মাঝখানে একটা আলোর ঝলকানি এসেছিল, আমরা আওয়ামী লীগ দল ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিলাম। আমরা তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ মনের মধ্যে বাসনা নিয়ে রাখলেও করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ শুরু করেছিলাম কিন্তু চূড়ান্ত রায় আমরা অর্জন করতে পারিনি তখন। এরপর ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একটা বীভৎস সময় দেখেছি জামায়াত-বিএনপির রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল তখন। তার মানে প্রায় ৩০ বছর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিরা ক্ষমতায় ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিরা আবার ক্ষমতায় আসলো এবং বিরাট জনসমর্থনে সেদিন আমরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিলাম। আমরা ক্ষমতায় আসার পর প্রথম আঘাতটা আসলো বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা দিয়ে। আমাদের সরকারের উপর প্রথম আঘাত ছিল সেদিন। সেদিন কতগুলো আর্মি অফিসারদের মৃত্যু ঘটানো হলো। এতগুলো আর্মি অফিসার কিন্তু কোন যুদ্ধেও মারা যায় না। এই আর্মি অফিসারদের মেরে সেদিন আমাদের সরকারকে বেকায়দায় ফেলা হয়েছিল। সেদিন শেখ হাসিনা ছিলেন বলেই এই বেকায়দায় অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ করা সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনা ছিলেন বলেই সেদিন এতো বড় একটা বিক্ষুব্ধ অবস্থা থেকে সেদিন আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বলেই আমরা সেই আঘাত উৎরিয়ে গেলাম। এরপরে আমরা সেটা উৎরিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত রায় অর্জন করলাম। এরপরে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করলাম যেটা আমদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। আল্লাহ্র অশেষ রহমতে জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে আমরা সেই বিচার কাজও শেষ করতে পেরেছি। আমি তখন আইন প্রতিমন্ত্রী ছিলাম। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছিল এবং ২০১২ সালের মাথায় আমরা প্রথম রায় পেয়েছিলাম। তারপর যখন আমরা ২০১৩ সালের দিকে এই রায় কার্যকর শুরু হয়েছে তখন এই হেফাজতের সেই ৫ মে এর তান্ডব হয়েছিল। ২০১৩ সালের সেই শাপলা চত্বর ছাড়ার পর ২০১৫ সালের শেষে দিক থেকে আবারও আলোচনায় আসতে শুরু করে সংগঠনটি। পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন থেকে শুরু করে, সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপন করা থেমিসের ভাস্কর্য সরানোর ভাবনা এবং সবশেষ কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি পাওয়া। আজকে এদের আসল রূপ মানুষের কাছে একেবারে খোলাসা হয়ে গিয়েছে। তাই এদের বিরুদ্ধে আজ সবার ঐক্যবদ্ধ জনমত গড়ে তুলতে হবে।
মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য চিরদিন কলঙ্কতম অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। কারণ, এইদিন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামকে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত, সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে রাষ্ট্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে মানুষের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে সেই সাংবিধানিকভাবে বৈধ সরকারকে উৎখাত করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। সুতরাং, একটি সাংবিধানিকভাবে বৈধ সরকারকে অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় উৎখাতের চেষ্টা চালিয়েছিল যেটা ছিল রাষ্ট্রদোহিতামূলক অপরাধ। সুতরাং সেদিনই তারা রাষ্ট্রদোহিতামূলক অপরাধ করেছিল। তারা যে এটা করেছিল এর পূর্বে তারা একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। সেই ক্ষেত্রটা হচ্ছে ধর্মের দোহাই, যেটা আমরা সেই পাকিস্তান আমল থেকে শুনে আসছি। অর্থাৎ যারা উদার গণতান্ত্রিক কথা বলবে, যারাই সম্প্রীতির কথা বলবে, যারাই ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকারের কথা বলবে, যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে কথা বলবে, যারাই ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলবে, অর্থাৎ আমরা যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একটি আদর্শ সৃষ্টি করেছিলাম, এর পক্ষে যারা কথা বলবে তাদেরকে এরা বলবে ধর্ম বিরোধী। সুতরাং সে জায়গাটিকে শক্তিশালী করার জন্য তারা সামনে একটা ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করলো। ২০১০ সালে নারী নীতির বিরোধিতা করে আলোচনায় আসা হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালের ৫ মে’র তান্ডবের পরও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। ৫ মে অবরোধ কর্মসূচির আড়ালে হেফাজতে ইসলাম রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার পরিকল্পনা করেছিল। এ জন্য তারা হেফাজতের তৎকালীন মহাসচিব ও সদ্যবিলুপ্ত কমিটির আমির আল্লামা জোনায়েদ বাবুনগরীকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করে একটি মন্ত্রিপরিষদও গঠন করেছিল। ওই মন্ত্রিপরিষদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন সম্প্রতি যৌন কেলেঙ্কারিতে আলোচনায় আসা মাওলানা মামুনুল হক। কিন্তু হেফাজতের অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালালে তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আট বছর পর সরকারের কঠোর পদক্ষেপে ভেঙে পড়েছে হেফাজতে ইসলাম। মোদিবিরোধী আন্দোলনের নামে সাম্প্রতিক সহিংসতায় সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে কমিটিও ভেঙে দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজত নারীর বিষয়ে তাদের যে অবস্থান ব্যক্ত করেছে এখনও তারা সেখানেই রয়েছে। মৌলিক কোনও পরিবর্তন তাদের মধ্যে দৃশ্যমান হয়নি। তারা কখনও মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার আগেও করেনি এখনো করছে না। এরকম প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী সংগঠনকে জায়গা করে দেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে।
ভোরের পাতা/পি