‘বয়স যদি আঠারো হয় ভোটার হতে দেরি নয়’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ মঙ্গলবার (২ মার্চ) সারাদেশে সীমিত পরিসরে ভোটার দিবস পালন করছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় ভোটার দিবসে প্রাপ্তবয়স্ক সব নাগরিককে ভোটার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদত হোসেন চৌধুরী বলেছেন,‘ভোট আপনার নাগরিক অধিকার। তাই আসুন সঠিক তথ্য দিয়ে ভোটার হোন। ভোটার হলে আপনি জাতীয় পরিচয়পত্র পাবেন। ভোটার হলে আপনার সবধরনের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হবে। যখন ভোটার হবেন তখন অবশ্যই সঠিক তথ্যগুলো দিবেন। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ভোটার হওয়ার উপযোগী প্রত্যেক নাগরিককে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। কারণ ভোটার না হলে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না। নাগরিক পরিচয়পত্রও পাবেন না।’
ভোটার দিবস সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে নিজ দফতরে ভোরের পাতাকে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। এসময় সুষ্ঠু নির্বাচনে ইসির ভূমিকা, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে অনীহা, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, নির্বাচনী অবকাঠামোসহ সাম্প্রতিক সময়ের নানা প্রসঙ্গে কথা বলেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদত হোসেন চৌধুরী।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিশিষ্ট ৪২ নাগরিকের দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে দৈনিক ভোরের পাতাকে তিনি বলেন. নির্বাচন এবং গণতন্ত্র দুইটার সাথে একটা গভীর সম্পর্ক আছে। নির্বাচনটা গণতন্ত্র প্রক্রিয়ার অন্যতম একটা ধাপ। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যেখানে নির্বাচন হচ্ছে, কিন্তু গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে অনেক পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের যে কয়টা গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক দায়িত্ব রয়েছে এরমধ্যে নির্ভুল একটি ভোটার তালিকা করা অন্যতম কাজ। মূলত আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটা নির্ভুল ভোটার তালিকা করা। কিন্তু সেখানে স্থানীয় সরকারের অন্য অন্য নির্বাচনও চলে আসে।
তিনি বলেন, ২০০৬ সালের ভোটার তালিকা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ল্যাক আব ট্রাস্ট (বিশ্বাসের ঘাটতি) তৈরি করেছিল। বিবাদমান একটা পরিস্থিতি ছিল। কারণ কিছু কিছু রাজনৈতিক দল মনে করতো তখনকার যে ভোটার তালিকা ছিল সেখানে দ্বৈত ভোটার বা বিভিন্ন জায়গায় ভোটার হয়েছে এমন ব্যক্তির নাম রয়েছে। ওই সময়ই সিদ্ধান্ত হয়েছিল ছবিসহ ভোটার তালিকা করার। কোর্টেরও আদেশ ছিলো একটা নির্ভুল ভোটার তালিকা করা।
বর্তমান ভোটার তালিকাকে নির্ভুল দাবি করে শাহাদত হোসেন চৌধুরী বলেন, অন্য সময় আগের ভোটার তালিকার নতুন ভোটারদের যোগ করে আপডেট ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়। কিন্তু ২০০৭ সালের আগের ভোটার তালিকা সম্পূর্ণ বাদ করে ছবিসহ নতুন ভোটার তালিকা করা হয়েছে। প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ডিজিটালি তাদের ডাটা এন্ট্রি করে তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়া হয়েছে। এগুলো সার্ভারে আপলোড করে আবার ম্যাচিং করা হয়েছে যে একই ব্যক্তি অন্য কোথাও ভোটার হয়েছে কিনা কিংবা একবার ভোটার হয়ে সে আবার ভোটার হচ্ছে কিনা। তখন সে ভোটার তালিকার একটা সার্ভেও হয়েছে। সার্ভের মূল উদ্দেশ্য ছিলো দুটো বিষয়ে- একই ব্যক্তির নাম দুই এলাকার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিনা কিংবা ভুয়া নামের লোকজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো কিনা। পাশাপাশি ভোটার হওয়ার যোগ্য কারো নাম আত পড়েছে কিনা। সার্ভেতে দেখা গেল ভোটার তালিকার ৯৮ ভাগই নির্ভুল। কাউকে কাউকে পাওয়া যায়নি তারা হয়তো বাড়িতে ছিল না অথবা ভোটার হতে আসেনি। িআমরা নিশ্চিত হলাম যে আমরা একটা নির্ভুল ভোটার তালিকা করেছি। তবে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য ছবিসহ ভোটার তালিকাটা কোন প্রার্থীকে আমরা দেইনি। আমাদের অফিসিয়াল ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে। ২০০৮ সালের পরে যারা ভোটার হয়েছে তারা ভোট দিতে গেলে নিজের ছবি দেখতে পারে এর ফলে একজনের ভোট আরেক জনের দেয়া যে ট্রেন্ট বা প্রথা ছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। একই সাথে আমরা জাতীয় পরিচয় পত্রও নিশ্চিত করেছি।
বর্তমানে ভোটের পরিবেশের কারণে লোকজন ভোটার হতে নিরুৎসাহিত হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মনে করি ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য একটা পরিবেশ থাকা উচিত। সেই পরিবেশ তৈরীতে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলগুলো, সিভিল সোসাইটি, প্রশাসন এবং মিডিয়া সবার কমবেশি ভূমিকা আছে। শুধু নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় দাড় করালে সেটা কিন্তু এক পেশে হয়ে যাবে। আপনারা দেখেছেন পৌরসভা নির্বাচনে আমাদের লোক আছে শুধু রির্টানিং এবং সহকারি রির্টানিং অফিসার। বাকি যে লোকগুলো তাদেরকে আমাদের রিকুজেশন করতে হয় যারা বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারি। তাদেরকে আমরা প্রিজাইডিং অফিসার সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার এবং পুলিং অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেই। দ্বিতীয় হলো, আচারণবিধি সঠিকভাবে পালন হচ্ছে কিনা, কোথাও গোলমাল হচ্ছে কিনা সেটার জন্য আমরা প্রশাসন থেকে এক্সিকিউটিব এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেই।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ, র্যাব, আনসার কাজ করে এখানে সকলের সহযোগীতা যদি আমরা পাই তাহলে ভোটের একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরী হয়। পাই না যে সেটা বলবো না। অনেক ক্ষেত্রে যেটা হয় আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নির্ভর করে দেশের নির্বাচন এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক রাজনীতিবিদ নির্বাচনকে প্রভাব করতে চেষ্টা করে। সেই প্রভাব এমন একটা পর্যায়ে চলে যায় যেখানে অনেক সময় তাদের মানি পাওয়ার এবং মাসেল পাওয়ারের ব্যবহার হয়ে যায়। সেই জায়গাটায় হয়তো অনেক ভোটার তাদের ভোট দিতে পারে না।
বিএনপি বর্তমান কমিশনের অধীনে আর কোন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার বলেন, বিএনপি বা কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে কিনা এটা তো তাদের বিষয়। আমি মনে করি নির্বাচন কমিশন থেকে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। একটু আধটু প্রবলেমতো থাকবেই তার জন্য পরো নির্বাচনতো বন্ধ করা ঠিক হবে না। আমাদের মূল উদ্দেশ্যটা হলো নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। নির্বাচনের পরিবেশটা স্থানীয় রাজনীতিবিদরা প্রায়ই নষ্ট করে। কারণ তারা মনে করে নিজের যে প্রার্থী আছে তাকে জেতাতেই হবে। যখন এমন পরিস্থিতি তৈরী হয় তখন পরিবেশটা নষ্ট হয়। তাছাড়া রাজনৈতিক পথটা এতো মসৃন নয়। এটা জটিল একট বিষয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনও আমরা দেখেছি সেখানে কিন্তু মার্শাল ‘ল’ এর মধ্যেও নির্বাচন হয়েছে।
সেই জায়গাটায় আমি মনে করি সেই পথটা রাজনীতিবিদদেরকে পাড়ি দিতেই হয় কোন দলই কিন্তু মসৃনভাবে কাঙ্খিত জায়গায় যেতে পারেনি। নির্বাচন পরিচালনায় রাজনৈতিক ভাবে সরকার থেকে আমাদের উপর কোন চাপ নেই, ব্যক্তিগত ভাবে আমি কখনো পাইনি। সাংবিধানিক যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সেটুকু পালন করার চেষ্টা করেছি। একটি অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ আইনানুগ নির্বাচন করার জন্য সব সময় যে আমরা সার্থক হয়েছি সেটা আমরা বলবো না। দুই একটা ব্যর্থতা তো থাকতেই পারে। আমাদের যে দায়িত্ব পালন এটা কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নির্বাচন সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল। সেখানে সরকার রাজনৈতিক দল এবং সিভিল সোসাইটি কতটুকু সহায়তা করছে সে বিষয়গুলো এসে যায়।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে শাহাদত হোসেন বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ করা হয়েছে সে বিষয়ে খুব দৃঢ়তার সাথে আমি বলতে পারি সেগুলোর কোন সত্যতা নেই। এই অভিযোগ আমাদের কলঙ্কিত করার জন্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, অভিযোগ উঠেছে আমি নাকি চারটি গাড়ি ব্যবহার করি যা মোটেও সত্য নয়, যখন আমার পদাধিকারের গাড়ি ছিলো না তখন আমি প্রকল্পের একটি গাড়ি ব্যবহার করতাম তাও সরকারের নির্ধারিত জ্বালানি খরচের মধ্যে।
তিনি বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ ফি নেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রথমত এটা অবৈধ নয় বৈধভাবেই আমাদের জন্য বরাদ্দ। আগের সব কমিশন এই প্রশিক্ষণ ফি নিয়েছেন। আমি শুরুতে এটা নেইনি কিন্তু দেখলাম এটা না নিলে অন্যদের জন্য সমস্যা হয়। কেউ নিচ্ছে কেউ নিচ্ছে না এটা খারাপ দেখা যায়। তাছাড়া আমার বরাদ্দেব টাকাটা আমি না নিলে সেই টাকাটা কি করবে এনিয়েও সমস্য হয় এজন্য নেয়া। অথচ এত ছোট একটা বিষয় নিয়েও কথা হচ্ছে। আমি শুধু বলবো, আমাদের বিরুদ্ধে বিশিষ্ট নাগরিকরা দুর্নীতির যে অভিযোগ এনেছে তা ভিত্তিহীন পারলে তারা প্রমাণ দিক।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সম্প্রতি ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক দ্বিতীয় আরেকটি চিঠি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতির কাছে। চার পাতার যে দ্বিতীয় চিঠিটি দিয়েছেন সেখানে একটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং ৫টি জাতীয় দৈনিকের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের লিঙ্ক সংযুক্ত করা হয়েছে। ১৭ জানুয়ারি দেয়া ঐ চিঠিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুত্বর অসদাচরণের অভিযোগ এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে ৪২জন বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষে স্বাক্ষরকারী আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছিলেন, সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং মহাহিসেব নিরীক্ষক, নির্বাচন কমিশনের আর্থিক দুর্নীতি বিষয়ে মত দিয়েছেন।